নামজারী করার প্রয়োজনীয়তা ও পদ্ধতি
যে কোন জমি কেনাবেচা বা হস্তান্তর করতে চাইলে বেশকিছু আইনি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে তা সম্পন্ন করতে হয়। বিশেষত, জমি কেনাবেচার ক্ষেত্রে রেজিস্ট্রেশনের পরেই যে গুরুত্বপূর্ণ আইনী প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন করা জরুরী তা হলো নামজারী বা মিউটেশন (Mutation)। নামজারী করা না থাকলে আইনের ফাঁক ফোকরে নানা ভাবে সম্পত্তি বেদখল হওয়ার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়। অথচ এই গুরুত্বপূর্ণ আইনী বিষয়টি এখনও পর্যন্ত জনসাধারণের কাছে দূর্বোধ্য। নামজারী বা মিউটেশন কি, কেন জরুরী, কিভাবে নামজারী করতে হয়, সব প্রশ্নের বিস্তারিত তুলে ধরা হলো আজকের এই লেখায়-
নাম জারি কাকে বলে?
ভূমি মালিকানার রেকর্ড বা খতিয়ান আপডেট বা হালনাগাদ করার পদ্ধতি হচ্ছে নামজারি বা মিউটেশন। কোন মালিক কোন জমির মালিকানা লাভ করার পর তার নাম সংশ্লিষ্ট খতিয়ান অন্তর্ভুক্ত করা বা তার নিজ নামে নতুন খতিয়ান খোলার যে কার্যক্রম তাকে মিউটেশন বা নামজারী বলে। সহজ ভাষায় বলতে গেলে রেকর্ডিয় এর মালিকের পরিবর্তে বর্তমান মালিকের নাম লিপিবদ্ধ করে খতিয়ান সংশোধন করাই হলো নামজারি। নামজারি বা মিউটেশনকে কোন কোন অঞ্চলে জমাখারিজ বলা হয়। নামজারি করার প্রধান উদ্দেশ্য হল জমির সঠিক মালিক এবং ভোগদখলকারের নিকট থেকে ভূমির কর বা খাজনা আদায় করা।
বিভিন্ন প্রকারের নামজারি
ভূমিতে মালিকানা অর্জনের ধরন অনুযায়ী নামজারির ধরণও বিভিন্ন প্রকার হয়ে থাকে। মালিকানা অর্জনের ধরন অনুযায়ী নাম যা রেখে নিন্মুক্ত ভাগে ভাগ করা যায়।
১. উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত সম্পত্তির নামজারি : কোন ব্যক্তি ওয়ারিশ রেখে মারা গেলে তার ওয়ারিশান নিজেদের মধ্যে সমঝোতার ভিত্তিতে একটি বন্টননাম্বা দলিল সম্পাদন ও রেজিস্ট্রি করেন। অতঃপর বন্টননাম্বা দলিল এবং ওয়ারিশান সার্টিফিকেটসহ সহকারী কমিশনার (ভূমি) বরাবর নামজারির আবেদন দাখিল করা হয়। সহকারি কমিশনার (ভূমি) কাগজপত্র যাচাই করে নামজারীর আদেশ দিবেন। উল্লেখ্য এক্ষেত্রে নতুন কোন হোল্ডিং খোলার প্রয়োজন নেই মৃত ব্যক্তির নামের স্থলে ওয়ারিশদের নাম রেকর্ড হবে।
২.হস্তান্তর দলিল বলে নামজারি: একটি হস্তান্তর দলিল যথাযথভাবে রেজিস্ট্রেশনের পর সাব-রেজিস্টার উক্ত হস্তান্তর নোটিশ সহকারী কমিশনার (ভূমি) অফিসে প্রেরণ করেন। নোটিশ প্রাপ্তির পর এসিল্যান্ড তার অফিসে একটি নামজারির কেস নথি করেন। এরপর তহশীলদার অফিসের নিকট প্রেরণ করেন। তহশীলদার যাচাই-বাছাই করে এসিল্যান্ডের নিকট প্রতিবেদন জমা দিবেন।
৩. সার্টিফিকেট মূলে নামজারি : কোন সম্পত্তি আদালত কর্তৃক নিলামে বিক্রয় হলে আদালত নিলাম ক্রেতা বরাবর একটি সার্টিফিকেট প্রদান করেন। একে বলা হয় বয়নামা। জমির মালিকানা লাভের পর আদালতের নিকট হতে দখলনামা সার্টিফিকেট এর প্রয়োজন হবে ও দখলনামার ভিত্তিতে এসিল্যান্ডের নিকট নামজারির আবেদন করা হবে এভাবে সার্টিফিকেট বলে নামজারি করা হয়।
৪. আদালতের ডিক্রি বলে নামজারি : মালিকানা বিষয়ে বিরোধ প্রমাণ আছে এমন ভূমি অথবা সরকারি খাস জমির নামজারি করতে হলে ডিক্রির প্রয়োজন হয়। এখতিয়ার সম্পন্ন দেওয়ানী আদালতের ডিক্রি ছাড়া নামজারি আদেশ প্রদান করতে পারেন না।
নাম জারি করার প্রয়োজনীয়তা
১. মালিকের মৃত্যুর কারণে উত্তরাধিকারীদের নাম লিপিবদ্ধ করার জন্য
২. জমির মালিকানা যদি বিক্রয় দান বিনিময় ইত্যাদি কারণে পরিবর্তিত হয়
৩. সিকস্তি পয়স্তির কারণে জমির মালিকানা পরিবর্তিত হলে
৪. ভূমি অধিগ্রহণ মোকদ্দমার মাধ্যমে মালিকানা পরিবর্তিত হলে
৫. নিলাম ক্রেতা নিলামে সম্পত্তির মালিকানা অর্জন করলে
৬. ডিক্রি মূলে কেউ সম্পত্তিতে মালিকানা অর্জন করলে
৭. খাস জমি বন্দোবস্ত বলে মালিকানা অর্জন করলে
৮. অগ্র-ক্রয় (Pre-emption) মোকদ্দমার মাধ্যমে জমির মালিকানা অর্জন করলে।
কোন কোন ক্ষেত্রে নামজারি করার প্রয়োজন নেই
দুইটি জরিপের মাঝখানে জমির মালিকানা পরিবর্তিত হলে সর্বশেষ মালিকের নামে নামজারির প্রয়োজন হয়। তবে সর্বশেষ জরিপে খতিয়ানে যার নাম সঠিকভাবে রেকর্ড রয়েছে তিনি যদি তার জীবদ্দশায় তার জমি বিক্রি না করেন তবে নামজারি করার প্রয়োজন নেই।
জমি নামজারি করার প্রয়োজনীয়তা-
অনেকেই মনে করেন জমির দলিল থাকলে নামজারি করার প্রয়োজন নেই। দলিলের মাধ্যমে মালিকানা অর্জিত হয় তবে সরকারি রেকর্ড পত্রে তার মালিকানা প্রতিষ্ঠিত হয় না। কারণ দলিলগ্রহীতা যদি নিজের নামে নামজারি না করেন তাহলে খতিয়ানে পূর্বের মালিকের নামেই থেকে যায়। নামজারি না করলে ভূমিতে মালিকানা এবং দখল সংক্রান্ত বিরোধ থেকে যায়। সরকারি নথিপত্রে বা খতিয়ানে মালিক হিসেবে স্বীকৃতি পেতে হলে নামজারি আবশ্যক। নামজারির মাধ্যমে ভূমি মালিকানার পাশাপাশি ভূমিতে দখল প্রতিষ্ঠিত হয়। নামজারি থাকলে একটি বিরুদ্ধ সত্য জনিত দখল মূলে মালিক বলে দাবী করতে পারে না। নামজারির খতিয়ান ভূমিতে মালিকের নিরঙ্কুশ মালিকানা প্রমাণ করে। কোন ব্যক্তি ভূমির মালিক সেজে প্রতারণামূলকভাবে উক্ত সম্পত্তি অন্য কারো কাছে হস্তান্তর করতে পারে না। সম্পত্তি বিক্রয় বা হস্তান্তর করতে হলে সংশ্লিষ্ট সম্পত্তিতে নামজারী থাকতে হবে। মালিকের নামে নামজারি না থাকলে তিনি তার সম্পত্তি কোনরুপ হস্তান্তর করতে পারবে না।
নামজারী কিভাবে করতে হয়
নামজারি করার ক্ষেত্রে রাজস্ব কর্মকর্তা প্রজাস্বত্ব বিধি ১৯৫৪ এর বিধি ২২ থেকে ২৪ অনুসরণ করে থাকেন। নামজারির প্রক্রিয়া নিম্নরুপ-
নামজারি করার ক্ষেত্রে যে সকল কাগজপত্র প্রয়োজন
দলিল বা অন্যান্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্র রাজস্ব কর্মকর্তা বা সহকারী কমিশনার (ভূমি) এর কার্যালয়ে যথাযথ নিয়মে আবেদন করতে হবে। সহকারী কমিশনার (ভূমি) অফিসে আবেদন করার পর র অফিসে একটি নথি খুলবেন। উক্ত আবেদনের মিউটেশন ফি ১১০০ টাকা জমা দিতে হবে। আবেদন জমা দিতে যা যা লাগবে-
১. আবেদনকারীর নাম ও ঠিকানা
২.রেজিস্ট্রীকৃত হস্তান্তর দলিল যেমন সাবকবলা, হেবা, বিনিময়, উইল ইত্যাদি
৩. দলিলের অনুলিপি এবং বায়া দলিনের ফটোকপি (যদি থাকে)
৪. পর্চা বা খতিয়ানের ফটোকপি
৫ ডিসিআর এবং ভূমি উন্নয়ন কর পরিশোধের রশিদের কপি
৬ বণ্টননামা দলিল
৭. আবেদনকারীর পাসপোর্ট আকারের দুই কপি ছবি
৮ ওয়ারিশান সনদপত্র
৯ পূর্বের মালিকের নামে নামজারী করা থাকলে তার ফটোকপি
ভূমি অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটে অনলাইনেও নামজারী করা যায়। ওয়বেসাইট- https://mutation.land.gov.bd/
*লেখক- সারোয়ার কাশেম অপূর্ব- রিসার্চ এক্সিকিউটিভ, জুরিস্টিকো।
আরো পড়ুন- আয়কর আইনজীবীর যোগ্যতা ও কার্যাবলি