BlogFeature

বাংলাদেশে জনস্বার্থের মামলা

 জনস্বার্থের মামলা সমাজের ন্যায়বিচারের অগ্রণী হাতিয়ার 

জনস্বার্থের মামলা বা Public Interest Litigation (PIL) বাংলাদেশের আইনি প্রক্রিয়ায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এই ধরনের মামলাগুলি সাধারণত সামাজিক সমস্যা, মানবাধিকার লঙ্ঘন, পরিবেশ সুরক্ষা এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে ব্যক্তিগত বা সামষ্টিক অধিকার রক্ষার জন্য দায়ের করা হয়। জনস্বার্থের মামলাগুলি সামাজিক উন্নয়ন, ন্যায়বিচার ও মানবাধিকার রক্ষার ক্ষেত্রে একটি শক্তিশালী হাতিয়ার হিসাবে কাজ করে। বাংলাদেশে ১৯৯৬ সালে ড. মহিউদ্দিন ফারুক বনাম বাংলাদেশ মামলা দিয়ে সুপ্রিমকোর্ট জনস্বার্থ মামলার বিষয়ে বিচারিক ভূমিকার পরিধি বাড়ানোর যাত্রা শুরু করেন।

 

জনস্বার্থের মামলার ধারণা

জনস্বার্থের মামলা হল এমন একটি আইনি প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে জনসাধারণের কোনো গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে উচ্চ আদালতে মামলা দায়ের করা হয়। এই ধরনের মামলাগুলি সাধারণত ব্যক্তি, গোষ্ঠী বা এনজিও দ্বারা দায়ের করা হয়, যেখানে সমাজের বৃহত্তর অংশের কল্যাণ ও সুরক্ষার উদ্দেশ্য থাকে। এটি আদালতের মাধ্যমে সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হয়।

 

 বাংলাদেশে জনস্বার্থের মামলার ইতিহাস

বাংলাদেশে জনস্বার্থের মামলার শুরু হয়েছিল ১৯৯০-এর দশকে। এই সময়ে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ মামলা দায়ের করা হয়, যা দেশের সামাজিক, পরিবেশগত এবং মানবাধিকার বিষয়ক ইস্যুগুলির উপর প্রভাব ফেলেছিল। এই ধরনের মামলাগুলির মাধ্যমে দেশের আইন ও বিচার ব্যবস্থায় একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়, যা জনগণের অধিকার এবং সুরক্ষার প্রতি আরও বেশি গুরুত্ব দেয়।

 

জনস্বার্থের মামলার উদ্দেশ্য

১. সরকারি সংস্থার দায়বদ্ধতা নিশ্চিতকরন: সরকারি প্রতিষ্ঠান বা কর্তৃপক্ষ যেন তাদের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করে, তা নিশ্চিত করে।

২. আইন লঙ্ঘন রোধ করে: কোনো ব্যক্তি বা সংস্থা আইন লঙ্ঘন করলে, তা প্রতিরোধ এবং সংশোধন করে।

৩. মৌলিক অধিকার সুরক্ষা করে: সাধারণ জনগণের মৌলিক অধিকার সুরক্ষিত রাখে।

৪. প্রাকৃতিক সম্পদ রক্ষা করে: প্রাকৃতিক পরিবেশ এবং সম্পদ সংরক্ষণ ও রক্ষা করে।

৫. সামাজিক সুবিচার নিশ্চিত করে: সমাজের সকল শ্রেণীর মানুষ যাতে ন্যায়বিচার পায়, তা নিশ্চিত করে।

৬. গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও নীতি রক্ষা করে: গণতন্ত্র ও ন্যায়বিচারের মূলনীতি বজায় রাখে।

 

জনস্বার্থের মামলার প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলো হলো:

১. জনস্বার্থকে প্রধান্য দেওয়া: মামলাটি ব্যক্তিগত স্বার্থের পরিবর্তে সমাজের বৃহত্তর অংশের কল্যাণের জন্য দায়ের করা হয়।

২. সংক্ষিপ্ত প্রক্রিয়া: এই ধরনের মামলাগুলো প্রায়শই দ্রুত নিষ্পত্তি করার জন্য বিশেষ প্রক্রিয়া অনুসরণ করে, যাতে ক্ষতিগ্রস্ত জনগোষ্ঠী দ্রুত প্রতিকার পায়।

৩. প্রমাণের প্রয়োজনীয়তা কম: মামলা দায়ের করার জন্য প্রমাণের স্তর তুলনামূলকভাবে কম, কারণ এর উদ্দেশ্য জনস্বার্থ রক্ষা করা।

৪. উদার বিচারক্ষমতা: আদালত এ ধরনের মামলায় প্রমাণ ও সাক্ষ্য গ্রহণে উদারতা দেখায় এবং গণমাধ্যম ও সমাজের মতামত গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করে।

৫. প্রতিরক্ষামূলক: অনেক ক্ষেত্রে এটি প্রতিরক্ষামূলক পদক্ষেপ হিসেবে কাজ করে, ভবিষ্যতে অনুরূপ অন্যায়ের প্রতিরোধ করে।

৬. দলভুক্ত বাদী-বিবাদী: মামলাটি যে কেউ করতে পারেন, এমনকি যার ব্যক্তিগতভাবে কোনো ক্ষতি হয়নি তেমন ব্যক্তিও করতে পারেন, যদি তার উদ্দেশ্য জনস্বার্থ রক্ষা হয়।

৭. নিম্ন আদালতের বাইরেও হতে পারে: এই মামলাগুলো কেবল উচ্চ আদালতে নয়, কোনো বিশেষ ট্রাইব্যুনাল বা কমিশনেও দায়ের করা যেতে পারে।

৮. বিচারের বিস্তৃত প্রভাব: মামলার ফলাফল সাধারণত সমাজের একটি বৃহৎ অংশের উপর প্রভাব ফেলে এবং ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় সহায়ক হয়।

 

আইনের ধারা ও প্রাসঙ্গিক বিধান

বাংলাদেশের সংবিধান ও আইনের বিভিন্ন ধারা জনস্বার্থের মামলার দায়ের ও পরিচালনার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

১.বাংলাদেশের সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১০২ অনুযায়ী, যে কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী যদি মনে করে যে তাদের মৌলিক অধিকার লঙ্ঘিত হয়েছে, তারা উচ্চ আদালতে রিট আবেদন করতে পারে। এই ধারা অনুযায়ী, আদালত মৌলিক অধিকার রক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দিতে পারে।

২. বাংলাদেশের সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৩২ অনুযায়ী মানুষের জীবন ও ব্যক্তিস্বাধীনতার অধিকার রক্ষার জন্য আইনি পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়। এটি জনস্বার্থের মামলাগুলির মূল ভিত্তি হিসাবে কাজ করে, যা ব্যক্তির জীবন ও স্বাধীনতার সুরক্ষার জন্য গুরুত্বপূর্ণ।

৩. সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৩১ অনুযায়ী, দেশের প্রতিটি নাগরিক ও অন্যান্য ব্যক্তির আইন দ্বারা সংরক্ষিত জীবনের নিশ্চয়তা, স্বাধীনতা, মর্যাদা এবং সম্পত্তির অধিকার রয়েছে। এই ধারা অনুযায়ী, কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী যদি মনে করে যে তাদের অধিকার লঙ্ঘিত হয়েছে, তাহলে তারা আদালতের মাধ্যমে প্রতিকার পেতে পারে।

 

জনস্বার্থের মামলার উদাহরণ:-

১. বুড়িগঙ্গা নদী দূষণ মামলা

১৯৯৫ সালে বুড়িগঙ্গা নদীর দূষণ প্রতিরোধে একটি জনস্বার্থের মামলা দায়ের করা হয়। বাংলাদেশ পরিবেশ আইনজীবী সংস্থা (বেলা) এ মামলাটি দায়ের করে, যা নদীর দূষণ প্রতিরোধে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসাবে কাজ করেছে। আদালত বুড়িগঙ্গা নদীর সুরক্ষার জন্য বিভিন্ন নির্দেশনা দেয়, যা পরিবেশ সুরক্ষার ক্ষেত্রে একটি মাইলফলক।

২. রানা প্লাজা দুর্ঘটনা মামলা

২০১৩ সালে সাভারের রানা প্লাজা ভবন ধসে বহু শ্রমিক নিহত ও আহত হয়। এ দুর্ঘটনার পর ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিকদের অধিকার ও সুরক্ষার জন্য বিভিন্ন এনজিও এবং ব্যক্তি উচ্চ আদালতে জনস্বার্থের মামলা দায়ের করেন। আদালত এ মামলার পরিপ্রেক্ষিতে শ্রমিকদের ন্যায্য ক্ষতিপূরণ এবং দোষীদের বিচার নিশ্চিত করতে বিভিন্ন নির্দেশনা দেন।

৩. খাদ্য ভেজাল প্রতিরোধ মামলা

২০১২ সালে খাদ্য ভেজাল প্রতিরোধে বাংলাদেশ কনজিউমার অ্যাসোসিয়েশন একটি জনস্বার্থের মামলা দায়ের করে। এ মামলায় আদালত খাদ্য ভেজাল রোধে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণের নির্দেশ দেন এবং খাদ্য উৎপাদন ও বিপণনের ক্ষেত্রে নীতি-নির্দেশনা জারি করেন।

৪. ঢাকার বায়ু দূষণ মামলা

২০১৯ সালে ঢাকার বায়ু দূষণ রোধে একটি জনস্বার্থের মামলা দায়ের করা হয়। মামলার পরিপ্রেক্ষিতে আদালত বায়ু দূষণ নিয়ন্ত্রণে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সরকারকে বিভিন্ন নির্দেশনা দেন। এ মামলাটি পরিবেশ সুরক্ষার ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসাবে বিবেচিত হয়।

 

জনস্বার্থের মামলার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা ও প্রভাব

জনস্বার্থের মামলা বাংলাদেশের ন্যায়বিচার ও মানবাধিকার রক্ষার ক্ষেত্রে একটি শক্তিশালী হাতিয়ার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এই মামলাগুলি সমাজের বিভিন্ন ইস্যু সমাধান, পরিবেশ সুরক্ষা, মানবাধিকার লঙ্ঘন প্রতিরোধ এবং সামাজিক ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে।

এছাও জনস্বার্থের মামলা বাংলাদেশের আইন ও বিচার ব্যবস্থাতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এই মামলাগুলির মাধ্যমে সমাজের ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা, পরিবেশ সুরক্ষা এবং মানবাধিকার রক্ষা ও মানুষের মৌলিক অধিকার রক্ষা নিশ্চিত করা সম্ভব হয়। ভবিষ্যতে, জনস্বার্থের মামলাগুলি আরও কার্যকর ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে এবং সমাজের বিভিন্ন ইস্যু সমাধান ও ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে একটি প্রধান হাতিয়ার হিসেবে কাজ করবে। জনস্বার্থের মামলাগুলির প্রভাব ও গুরুত্ব উপলব্ধি করে, আমাদের সমাজের উন্নয়নে আমাদের নিজেদেরও আরও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে, যেন মানুষের মৌলিক অধিকার ও সুরক্ষা নিশ্চিত করা যায়।

*লেখক: মারুফ আসহসান- রিসার্চ এসোসিয়েট, জুরিস্টিকো।

 

 

আরো পড়ুন- বাংলাদেশে আইন নিয়ে পড়াশোনা

 

You cannot copy content of this page