জাতিসংঘের মহাসচিব নির্বাচন দায়দায়িত্ব ও কার্যাবলী
জাতিসংঘ বিশ্বের সবচেয়ে বড় আন্তর্জাতিক সংস্থা। যার প্রধান কাজ বিশ্বে শান্তি নিরাপত্তা ও মানবাধিকার রক্ষা করা। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তির পর এর ভয়াবহতা ও বিভীষিকা দেখার পর ১৯২৯ সালের ১০ই জানুয়ারি ‘লিগ অফ নেশনস’ নামক আন্তর্জাতিক সংস্থা গঠিত হয়। যার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল শান্তি শৃঙ্খলা স্থাপনা কিন্তু এই সংস্থার ব্যর্থতার পর বিশ্ব এক নতুন বিশ্বযুদ্ধের সম্মুখীন হয়। ১৯৩৯ সালের পহেলা সেপ্টেম্বর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয় যা ছিল মানব ইতিহাসের সবচেয়ে মারাত্মক সংঘাত। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে সামরিক হতাহতের সংখ্যা ছিল বেশি। তবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বেসামরিক হতাহতের সংখ্যা বেশি ছিল। এর প্রেক্ষিতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষে ১৯৪৫ সালের ২৪ অক্টোবর যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ার সানফ্রান্সিসকোতে জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠিত হয়। যাতে ভবিষ্যতে আর কোন বিশ্বযুদ্ধ না হয় এবং শান্তি বজায় থাকে। জাতিসংঘের মুখপাত্র হচ্ছে জাতিসংঘের মহাসচিব। মহাসচিব জাতিসংঘের সকল কার্যক্রম সমন্বয় ও পরিচালনা করে এবং আন্তর্জাতিক প্রাঙ্গণে জাতিসংঘকে প্রতিনিধিত্ব করেন। তিনি জাতিসংঘের সকল কার্যক্রমে নেতৃত্ব প্রদান করেন। যা দ্বারা বিশ্বের শান্তি ও সুরক্ষা সুনিশ্চিত হয়। জাতিসংঘের মহাসচিব নির্বাচন প্রক্রিয়াটি হচ্ছে একটি পরিকল্পিত প্রক্রিয়া। এই প্রক্রিয়াটি সম্পাদিত হয় জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্রগুলোর দ্বারা। এটি একটি নির্বাচন প্রক্রিয়া যার দ্বারা একজন অভিজ্ঞ ব্যক্তিকে জাতিসংঘের মহাসচিব হিসেবে নির্বাচিত করা হয়।
জাতিসংঘ মহাসচিব নির্বাচন প্রক্রিয়া
১. প্রার্থী নির্বাচন : যদি কেউ মহাসচিব পদে প্রার্থিতা পেতে চায় তাহলে তাকে অবশ্যই একটি সদস্য রাষ্ট্র হতে মনোনয়ন পেতে হবে। সাধারণত জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্রগুলো জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে অভিজ্ঞতা সম্পন্ন ও মর্যাদাবান ব্যক্তিদের প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন প্রদান করে থাকে।
২. নির্বাচন প্রচারণা: মনোনয়ন প্রাপ্ত সকল প্রার্থীরা নিজেদের পক্ষে প্রচারণা করতে পারে। এই প্রচারণায় সদস্য রাষ্ট্রগুলোর সাথে আলোচনার মাধ্যমে দেশগুলোকে তাদের লক্ষ্য ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে অবহিত করেন। এই প্রচারণার মূল লক্ষ্য হচ্ছে সদস্য রাষ্ট্রগুলোর বিশ্বাস এবং সমর্থন অর্জন করা যা মহাসচিব নিবেচিত হওয়ার জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
৩. নির্বাচন প্রক্রিয়া: মহাসচিব এর নির্বাচন প্রক্রিয়ায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ। নিরাপত্তা পরিষদের ১৫টি সদস্য রাষ্ট্র রয়েছে। যার মধ্যে ৫টি স্থায়ী সদস্য এবং ১০টি অস্থায়ী সদস্য রয়েছে। মহাসচিব নির্বাচন ভোটের মাধ্যমে সম্পাদিত হয়ে থাকে। এ নির্বাচন প্রক্রিয়ায় একজন প্রার্থীকে মহাসচিব হিসেবে নির্বাচিত হতে হলে নিরাপত্তা পরিষদের সদস্য দেশগুলো থেকে কমপক্ষে নয়টি ভোট এবং স্থায়ী সদস্য থেকে কোন ভেটো না পাওয়া প্রয়োজন। ভেটো প্রধান করা ক্ষমতা শুধুমাত্র স্থায়ী সদস্য দেশগুলোর রয়েছে। এই পদ্ধতিতেই জাতিসংঘের মহাসচিব নির্বাচিত হয়ে থাকে।
৪. মহাসচিবের মেয়াদকাল: জাতিসংঘের একজন মহাসচিব পাঁচ বছরের জন্য নির্বাচিত হন। অর্থাৎ পাঁচ বছর পর পুনরায় নির্বাচনের মাধ্যমে নতুন মহাসচিব নির্বাচিত হবে। তবে মহাসচিব এর অসাধারণ কার্যক্রমের জন্য তাকে পুনঃনির্বাচনের মাধ্যমে আরো পাঁচ বছর মেয়াদ বৃদ্ধি করা যেতে পারে। কিন্তু একজনকে মহাসচিব পদে তৃতীয়বার নিয়োগ দেওয়া হয় না।
জাতিসংঘ মহাসচিবের কার্যাবলি ও দায়দায়িত্ব
জাতিসংঘে ১৯৩ টি দেশ সদস্যপদ গ্রহণ করেছে। অর্থাৎ জাতিসংঘের কাজের পরিধি অত্যন্ত বিস্তৃত। জাতিসংঘের প্রধান কাজ গুলোর মধ্যে রয়েছে -আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তা, দেশগুলোর মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলা, আন্তর্জাতিক সহযোগিতা অর্জন এবং সদস্য দেশগুলোর ক্রিয়া-কলাপের সমন্বয় সাধন। এ সংস্থাটি সদস্য দেশগুলোর ক্রিয়া-কলাপের সমন্বয়ের একটি কেন্দ্র হিসেবে কাজ করে। নিম্নে মহাসচিব দ্বারা কৃত কিছু কাজের ব্যাপারে বলা হচ্ছে –
১. শান্তি ও নিরাপত্তা রক্ষা : জাতিসংঘের মহাসচিব এর অন্যতম প্রধান কাজই হচ্ছে বিশেষ শান্তি ও নিরাপত্তা রক্ষা যখন দুটি দেশে যুদ্ধ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয় তখন জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশন পরিচালনা করে প্রয়োজন অনুসারে সশস্ত্র প্রতিরোধ ও গড়ে তুলতে পারেন।
২. কূটনৈতিক মধ্যস্থতা : জাতিসংঘের মহাসচিব হলো নিরপেক্ষ। তাই তিনি আন্তর্জাতিক সমস্যা গুলো সমাধানে মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা পালন করে থাকেন। তিনি সদস্যরাষ্ট্র গুলোর সকল সমস্যার সমাধান বের করতে সর্বদা তৎপর।
৩. মানবাধিকার রক্ষা : জাতিসংঘের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কাজের ক্ষেত্র হচ্ছে মানবাধিকার রক্ষা। জাতিসংঘের সদস্য দেশগুলোতে যেন কোনোভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘিত না হয় তার প্রতি সর্বদা সজাগ দৃষ্টি রাখে। এছাড়াও বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ কিংবা মানব সৃষ্ট দুর্যোগে জাতিসংঘ মানবিক সহায়তা প্রদান করে থাকে দুস্থদের জন্য।
৪. উন্নয়ন ও ট্যাক্স উন্নয়ন লক্ষ্য ( SDGs) অর্জন : জাতিসংঘের মহাসচিব সর্বদা সদস্য দেশগুলোকে টেকসই উন্নয়ন (Sustainable Development Goals – SDGs) অর্জন করতে সাহায্য ও অনুপ্রাণিত করে। এই টেকসই উন্নয়নের অনর্ভুক্ত হচ্ছে শিক্ষার প্রসার, স্বাস্থ্য সেবা সুনিশ্চিত করা, এবং পরিবেশ সংরক্ষণ ইত্যাদি। এই বিষয়গুলোকে সফলভাবে বাস্তবায়ন করতে জাতিসংঘের মহাসচিব যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করে থাকে।
৫. প্রশাসনিক কার্যক্রম পরিচালনা : মহাসচিব জাতিসংঘের দৈনন্দিন প্রশাসনিক কার্যক্রম পরিচালনা করে। জাতিসংঘের কর্মচারী নিয়োগ, সংস্থার বিভিন্ন কাজের তদারকি, সংস্থার বাজেট প্রস্তুত ও বাস্তবায়ন ইত্যাদি কাজ করে থাকে। তার ওপরেই জাতিসংঘের কার্যক্রমের সফলতা ও গতিশীলতা নির্ভর করে।
জাতিসংঘের মহাসচিবের কাজ উক্ত সংস্থাটি এবং এর সদস্য দেশগুলোর জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ। তার ওপর বিশ্ব শান্তি নিরাপত্তা মানবাধিকার ও দেশগুলোর সার্বিক উন্নয়ন ন্যস্ত। জাতিসংঘের মহাসচিব একজন প্রশাসনিক নেতার পাশাপাশি একজন কূটনীতিক শান্তি দূত এবং মানবতার রক্ষক। তার কাজের পরিধি ব্যাপক। তিনি বিশ্ববাসীকে জাতিসংঘের উপর আস্থা রাখতে শেখান। তার নেতৃত্ব ও কাজের মাধ্যমে। জাতিসংঘের মূল লক্ষ্য – শান্তিপূর্ণ, সুরক্ষিত ও সমৃদ্ধ বিশ্ব করার স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করা। তাই তার কাজের দ্বারা তিনি শুধু প্রাতিষ্ঠানিক দায়িত্ব নয় বৈশ্বিক উন্নয়ন ঘটান।
*লেখক: ঐশী আহমেদ: এক্সিকিউটিভ মেম্বার, জুরিস্টিকো।
আরো পড়ুন- ন্যায়পালের দায়দায়িত্ব ও কার্যাবলি