BlogOpinion

ন্যায়পালের দায়-দায়িত্ব ক্ষমতা ও কার্যাবলি

ন্যায়পাল ধারণাটি সর্বপ্রথম সুইডেনে উদ্ভাবিত হয়, ১৮০৯ সালে সুইডেনের সংবিধানে এ পদটির সৃষ্টি। ক্রমান্বয়ে অন্যান্য দেশের সংবিধানে এই পদটির বিকাশ ঘটেছে। ১৯১৯ সালে ফিনল্যান্ডে, ১৯৫৫ সালে ডেনমার্কে, ১৯৬১ সালে নিউজিল্যান্ডে, ১৯৬৩ সালে নরওয়েতে, ১৯৬৭ সালে ব্রিটেনে এবং ১৯৭৩ সালে অস্ট্রেলিয়াতে এই পদটি সৃষ্টি করা হয়।

সুইডিশ ভাষার Ombudsman কে বাংলায় আমরা ন্যায়পাল বলি।

Ombudsman কথাটির অর্থ হলো প্রতিনিধি বা মুখপাত্র।

ন্যায়পাল বলতে এমন একটি জবাবদিহিতামূলক পদ বা প্রতিষ্ঠানকে বোঝায় যিনি সরকারি কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ তদন্ত করেন। তিনি অন্যের মুখপাত্র হিসেবে প্রতিনিধিত্ব করেন।

ন্যায়পাল থাকেন স্বাধীন ও নিরপেক্ষ। সরকারি কর্তৃপক্ষ এবং সাধারণ জনগণের মধ্যে তিনি মধ্যস্থতাকারী হিসেবে কাজ করেন। ন্যায়পাল সরকার, মন্ত্রণালয়, সরকারি কতৃপক্ষ, সরকারি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ সম্পর্কে তদন্ত শেষ রিপোর্ট করতে পারেন কিন্তু বাস্তবায়ন করতে পারেন না।

 

ন্যায়পাল হবার যোগ্যতা:

যেহেতু পদটি জনসাধারণের সার্থে সৃষ্টি করা হয়েছে তাই জনগণের রক্ষাকবচ হিসেবে ন্যায়পাল কাজ করেন। তার কার্যকারিতা নির্ভর করে ব্যক্তিগত চরিত্র, নিষ্ঠা এবং নিরপেক্ষতার উপর।

সুতরাং প্রবীণ কোনো আইনজীবী, প্রাক্তন বিচারক অথবা অবসরপ্রাপ্ত কোনো সম্মানিত ব্যক্তি যিনি সমাজে নন্দিত এবং যার উপর জনসাধারণের আস্থা আছে এমন ব্যক্তিকেই ন্যায়পাল হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়।

 

ন্যায়পালের নিয়োগ পদ্ধতি:

ন্যায়পালের নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রচলিত তিনটি পদ্ধতি রয়েছে। যা নিচে দেওয়া হলো

(১)আইনসভা কতৃক নির্বাচনের মাধ্যমে

(২)নির্বাহী প্রধান বা রাষ্ট্রপতির মাধ্যমে

(৩)আইনসভার অনুমোদন সাপেক্ষে নির্বাহী প্রধান কতৃক।

 

বাংলাদেশে ন্যায়পাল:

১৯৭২ সালের ৪ঠা নভেম্বর  গৃহীত মূল সংবিধানেই ৭৭নং অনুচ্ছেদে ন্যায়পাল পদে সৃষ্টির বিধান উল্লেখ করা হয়। এই ৭৭ নং অনুচ্ছেদটির আলোকে ১৯৮০ সালে The  Ombudsman Act 1980 (Act XV of 1980) এই আইনটি গৃহীত হয় যা এখন অব্দি কার্যকর করা হয়নি।

বাংলাদেশের সংবিধানের পঞ্চম ভাগে  আইনসভার প্রথম পরিচ্ছেদে ৭৭(১,২,৩) অনুচ্ছেদে বলা হয়।

৭৭(১)- সংসদ আইনের দ্বারা ন্যায়পালের পদ প্রতিষ্ঠার বিধান করতে পারেন।

৭৭(২)-সংসদ আইনের দ্বারা ন্যায়পালকে কোন মন্ত্রণালয়,সরকারি কর্মচারী বা সংবিধিবদ্ধ সরকারী কতৃপক্ষের যে কোনো কার্য সম্পর্কে তদন্ত পরিচালনার ক্ষমতাসহ যেরুপ ক্ষমতা কিংবা যেরুপ দায়িত্ব প্রদান করিবেন, ন্যায়পাল সেইরূপ ক্ষমতা প্রয়োগ ও দায়িত্ব পালন করিবেন।

৭৭(৩)-ন্যায়পাল তাহার দায়িত্বপালন সম্পর্কে বাৎসরিক রিপোর্ট প্রনয়ণ করিবেন এবং অনুরুপ রিপোর্ট সংসদে উপস্থাপিত হইবে।

 

ন্যায়পালের কার্যাবলি

ন্যায়পাল পদটির  প্রধান উদ্দেশ্য হলো জনসাধারণকে প্রশাসনের দুর্নীতি থেকে রক্ষা করা। নাগরিকগণ সরকারি কর্মচারী, সশস্ত্র বাহিনী ও বিচারকগণ তাদের দায়িত্ব ঠিকঠাক পালন করছে কিনা সেটি দেখার দায়িত্বও ন্যায়পালের।

এছাড়াও ন্যায়পাল বিভিন্ন কার্যাবলি সম্পন্ন করেন, যেমন তিনি বেসামরিক প্রশাসন ও আদালতের  কার্যক্রম তত্ত্বাবধান  করেন। তিনি সরকারি কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ যেমন বেআইনি কার্যকলাপ, কর্তব্যে গাফিলতি, ক্ষমতার অপব্যবহার সহ বিভিন্ন অভিযোগের স্পষ্ট তদন্ত করেন। এছাড়াও বিভিন্ন ধরনের প্রতারণামূলক কর্মকাণ্ড ও ন্যায়বিচার পরিপন্থী কার্যকলাপের উপর ন্যায়পাল বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। যদি কোনো কর্মকর্তা সংবিধান বহির্ভূত অনৈতিক কর্মকান্ডে জড়িত হন ও আইন লঙ্ঘন করেন তবে ন্যায়পাল তার বিরুদ্ধে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। সরকারি কতৃপক্ষ, প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষ থেকে শুরু করে দায়িত্বশীল কর্মকর্তা সকলকে বিধিবদ্ধ নিয়মকানুন এবং সংবিধানের আইন অনুযায়ী কাজ করতে বাধ্য করতে পারেন ন্যায়পাল। ন্যায়পাল সকল সরকারি কর্মকর্তা ও প্রতিষ্ঠানের  কার্যকলাপে সমতা ও সততা বিধানের প্রতি গুরুত্বারোপ করে থাকেন।

 

ন্যায়পালের সীমাবদ্ধতা:

সরকারি প্রতিষ্ঠান বা কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ তদন্তকারী দপ্তর হিসেবে কাজ করেন ন্যায়পাল। তার কাজ শুধুমাত্র তদন্ত করা এবং তদন্ত শেষে রিপোর্ট প্রনয়ণ করে তা প্রকাশ করা। শাস্তি প্রদানের ক্ষমতা ন্যায়পালের নেই। তবে এই সীমাবদ্ধতা প্রশাসনিক ও সরকারি কর্তৃপক্ষের কর্মকাণ্ডের উপর ন্যায়পালের নিয়ন্ত্রণ এবং সংশোধন ক্ষমতাকে অকার্যকর করতে পারে না। কোনো কর্মকর্তা যদি ন্যায়পাল প্রদত্ত সুপারিশ অস্বীকার করেন তাহলে ন্যায়পাল তার বিরুদ্ধে পাল্টা রিপোর্ট প্রনয়ণ করতে পারেন।

ব্যাতিক্রম কিছু ক্ষেত্রে ন্যায়পাল ক্ষতিপূরণের জন্য রিপোর্ট করতে পারেন যেমন: কোনো নাগরিকের সম্পত্তি বেদখলের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ক্ষতিপূরণ বিধান করে রিপোর্ট করতে পারেন।

 

ন্যায়পাল পদের যৌক্তিকতা :

একজন ন্যায়পাল  বা সরকারের বিরুদ্ধে অভিযোগ তদন্তকারী স্বাধীন কতৃপক্ষ থাকলে নির্বাহী কর্মকর্তাগণ স্বেচ্ছাচারী হতে পারেন না৷ বিচারক এবং ম্যাজিস্ট্রেটগণ পক্ষপাতিত্ব করার সুযোগ পাবেন না প্রশাসনের যে কোনো দুর্নীতির খবর পেলে ন্যায়পাল তৎক্ষনাৎ তদন্ত বা হস্তক্ষেপ করতে পারেন,এতে  কতৃপক্ষকে জবাবদিহিতার একটি বিষয় খেয়াল রাখতে হয়।

 

সর্বশেষ এই বিষয়টি স্পষ্ট যে ন্যায়পাল পদটির যথাযথ কার্যাবলি বা হস্তক্ষেপে প্রশাসন এবং সরকারি আমলাদের দুর্নীতি এবং অপকর্ম বহুলাংশে কমে যায়। ন্যায়পাল একটি স্বাধীন দপ্তর সেই কারণে এটি স্বাধীন ও নিরপেক্ষ ভাবে জনকল্যাণে কাজ করতে পারে।

*লেখক:  নোহা ভূঁইয়া: অ্যাওয়ারনেস এম্বাসেডর, জুরিস্টিকো।

 

আরো পড়ুন- সাংবিধানিক ও প্রশাসনিক সংস্কার প্রস্তাব

You cannot copy content of this page