বাল্যবিবাহের প্রভাব ও প্রতিকার
বাল্যবিবাহ বলতে একজন অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়ের সাথে আরেকজন অপ্রাপ্তবয়স্ক ছেলের বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া। বাংলাদেশের আইন অনুযায়ী ১৮ বছরের কম বয়সী একজন মেয়ের সাথে ২১বছরের কম বয়সী একজন ছেলের বিবাহকেই বাল্যবিবাহ বলে। এছাড়াও কোনো বিবাহের সময় যদি ছেলে বা মেয়ের মধ্যে যেকোনো একজন অপ্রাপ্তবয়স্ক হয় (ছেলে প্রাপ্তবয়স্ক তবে মেয়ের বয়স ১৮-এর কম) সেক্ষেত্রেও বিবাহটি বাল্যবিবাহ বলে বিবেচিত।
বাল্যবিবাহের কারণসমূহ
বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে বাল্যবিবাহের প্রধান এবং প্রথম কারণটিই হচ্ছে দারিদ্রতা। এছাড়াও রয়েছে লিঙ্গ বৈষম্য, সামাজিক প্রথা, অঞ্চলভিত্তিক রীতিনীতি, ধর্মীয় ও পারিবারিক চাপ, নিরক্ষরতা, মেয়েদের নিরাপত্তাহীনতা, সচেতনতার অভাব, মেয়েদের উপার্জনের অক্ষম ভাবা ইত্যাদি।
বাল্যবিবাহের অবস্থা
বাল্যবিবাহের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান দক্ষিণ এশিয়ায় শীর্ষে। বর্তমানে দেশে বাল্যবিবাহের হার ৫১.৪০শতাংশ এবং ১৫বছরের নিচে ১৫.৫০শতাংশ। (তথ্যসূত্র-প্রথম আলো, ০৪মার্চ ২০২৪)
বিগত বছরগুলোতে বাংলাদেশে বাল্যবিবাহের হার ছিলো ২০০৬ সালে ৬৪শতাংশ, ২০১২সালে ৫২শতাংশ, ২০১৯সালে ৫১শতাংশ। (তথ্যসূত্র-বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো)
বাল্যবিবাহের প্রভাব
বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল একটি দেশে বাল্যবিবাহ হচ্ছে এক ধরনের অভিশাপস্বরুপ। বাল্যবিবাহের ফলে ছেলে ও মেয়ে উভয়ের উপর নানা ধরনের ক্ষতিকর প্রভাব পড়ে থাকে। তবে ছেলেদের থেকে মেয়েদের উপরই এর প্রভাব বেশি পড়ে থাকে কেননা ছেলেদের তুলনায় মেয়েরাই বেশি বাল্যবিবাহের শিকার হয়। বাল্যবিবাহের প্রভাব মেয়েদের মাঝে এতো খারাপভাবে পড়ে যে, একটি মেয়ে প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পরেও তার নানা ধরনের সমস্যা দেখা দিতে থাকে। বাল্যবিবাহের প্রভাব একজন মেয়ে বা ছেলের উপর ছাড়াও দুইটি পরিবার এবং সমাজের উপরও পড়ে থাকে।
বাল্যবিবাহের কারণে নারীশিক্ষার হার হ্রাস, নারীর প্রতি সহিংসতা, নারীর অর্থনৈতিক সক্ষমতা কেড়ে নেওয়া, অপরিণত গর্ভধারণ, মাতৃমৃত্যু ঝুঁকি, প্রসবকালীন শিশুমৃত্যুর ঝুঁকি, প্রজনন স্বাস্থ্য সমস্যা ইত্যাদি ছাড়াও আরো নানান নেতিবাচক প্রভাব লক্ষনীয়।
নারীশিক্ষার হার হ্রাস:
বাল্যবিবাহ একটি মেয়ের শিক্ষাজীবনের সমাপ্তি ঘটায়। একটি অল্পবয়সী মেয়ের হঠাৎ করে বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর অচেনা জায়গা, নতুন পরিবার, ভিন্ন পরিবেশে নিজেকে মানিয়ে নেওয়ার আগেই তার কাঁধে তুলে দেয়া হয় একটি পরিবাবের দায়িত্ব আর যা সামলাতে গিয়েই একটি মেয়ের আর ফেরা হয় না শিক্ষাজীবনে।
অপরিণত গর্ভধারণ:
অপরিণত গর্ভধারণ মেয়েদের জীবনের জন্য হুমকিস্বরূপ। ১৫ থেকে ১৯ বছরের মেয়েদের মৃত্যুর অন্যতম কারণ অপরিণত বয়সে গর্ভধারণ। মেয়েদের গর্ভধারণের নিরাপদ বয়স হলো ২০ থেকে ২৯ বছর। ১৬ থেকে ১৮ বছরের নিচে মেয়েদের গর্ভাবস্থা ঝুঁকিপূর্ণ। কারণ একটি মেয়ে যদি অপরিণত বয়সে গর্ভধারণ করে, তাহলে সে নিজে যেমন আয়রন, ভিটামিন ও মিনারেলসের অভাবে ভুগবে, তেমনি তার গর্ভস্থ শিশুটিরও অপুষ্টিজনিত অনেক ধরনের জটিলতা দেখা দিতে পারে। অপরিণত গর্ভধারণের ফলে অপুষ্টি বা অপরিণত শিশুর জন্ম হয়ে থাকে।
মাতৃমৃত্যু:
মাতৃমৃত্যু হচ্ছে বাল্যবিবাহের এক ভয়ংকর পরিণতি। ১৫-১৯ বছর বয়সী গর্ভবতী নারীদের মাতৃমৃত্যুর সম্ভাবনা ২০ বছর বয়সী গর্ভবতী নারীদের তুলনায় দ্বিগুণ। আর ১৫ বছরের কম বয়সী নারীদের ক্ষেত্রে মাতৃমৃত্যুর সম্ভাবনা ৫-৭ গুন বেশি। যেসব নারী ১৫ বছরের পূর্বে সন্তান জন্মদান করে তাদের ফিস্টুলা বিকশিত হওয়ার সম্ভাবনা প্রায় ৮৮%। বাল্যবিবাহের পর যখন একটি মেয়ে সন্তান ধারণ করেন তখন তার শরীর গর্ভধারণে সক্ষম হয়ে উঠে না ফলে গর্ভকালীন সময়ে তার শরীরে নানান জটিলতা দেখা দিতে থাকে এবং যার শেষ পরিণতি ঘটে মাতৃমৃত্যু।
শিশুমৃত্যু:
বাল্যবিবাহ শুধুমাত্র মায়ের ক্ষেত্রেই না বরং শিশুর জন্যও হুমকি স্বরূপ। ১৮ বছরের নিচে মেয়েদের অপরিণত সন্তান জন্মদান বা কম ওজনের সন্তান জন্মদানের সম্ভাবনা ৩৫-৫৫% এবং শিশু মৃত্যুর হার ৬০%। এছাড়া যেসব নারী কম বয়সে শিশুর জন্ম দেয় ঐসব শিশুদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা খুবই দুর্বল হয় ও শিশু অপুষ্টিতে ভোগার সম্ভাবনা বেশি থাকে।
স্বাস্থ্য সমস্যা :
বাল্যবিবাহের কারণে নারীদের বিভিন্ন ধরনের স্বাস্থ্য সমস্যায় ভুগতে হয়। একজন ১৮বছরের কম বয়সী মেয়ে বিবাহ পরবর্তী শারীরিক বিষয় সম্পর্কে যথেষ্ট জ্ঞানসম্পন্ন থাকে না, তারা নিজেদের স্বাস্থের যথাযথ যত্ন নিতে পারে না ফলে তারা সহজেই বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয় এবং অপুষ্টিতে ভোগে।
বাল্যবিবাহের প্রতিকার
বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে ইতোমধ্যেই নানান কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। যার মধ্যে রয়েছে নারীর ক্ষমতায়ন বৃদ্ধি, নারীশিক্ষার হার বৃদ্ধি, বাল্যবিবাহের কুফল সম্পর্কে অভিভাবকদের অবহিত করা, সমাজে সচেতনতা বৃদ্ধি ইত্যাদি।
পুলিশ হেডকোয়ার্টার পরিচালিত জাতীয় ইমার্জেন্সি হেল্পলাইন ৯৯৯ এ কল করে বাল্যবিবাহ চলাকালে ফোন করে বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ করা যায়। এছাড়াও মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের হটলাইন ১০৯২১ এবং মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরের হটলাইন ১০৯ এ কল করেও বাল্য বিবাহ প্রতিরোধ করা যায়। তাৎক্ষণিকভাবে স্থানীয় প্রশাসন, উপজেলা নির্বাহী অফিসার, পুলিশ প্রশাসন, মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর ব্যবস্থা গ্রহণ করে থাকে।
এছাড়াও বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে বেশকিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করা যেতে পারে-
১. বাল্যবিবাহ প্রতিরোধের অন্যতম কার্যকর উপায় নারীশিক্ষা। তাই মেয়েদের শিক্ষার সুযোগ প্রদান করা (বিশেষ করে গ্রামীণ/প্রত্যন্ত এলাকায়)। শিক্ষাই পারে নারীদের তাদের জীবন সম্পর্কে সচেতন সিদ্ধান্ত নিতে মনোবল তৈরি করতে।
২. বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে পরিবারে, রাস্তাঘাটে এবং সমাজে নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। কেননা অনেক সময় দেখা যায় রাস্তাঘাটে বখাটেদের উত্যক্ত করার ফলে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগে অনেক পরিবার তাদের অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়েকে বিয়ে দিতে বাধ্য হয়।
৩. বাল্যবিবাহ সম্পর্কে জনগনের মনোভাব এবং সামাজিক রীতিনীতি পরিবর্তনে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে।
৪. বাল্যবিবাহের নেতিবাচক প্রভাবগুলো অভিভাবক, পরিবার এবং সমাজের লোকজনদের মাঝে তুলে ধরতে হবে।
৫. বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে সরকারি বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, বিভিন্ন এনজিও এবং নিজ উদ্যোগে বাল্যবিবাহ রোধের সচেতনতামূলক প্রচার প্রচারণা চালাতে হবে।
৬. বিভিন্ন ধরনের গণমাধ্যম এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বাল্যবিবাহের কুফল প্রচার করতে হবে যাতে এসব মাধ্যম ব্যবহারকারীরা সহজেই বাল্যবিবাহের কুফল সম্পর্কে জানতে পারে।
৭. বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে যেসকল আইন এবং শাস্তির বিধান রয়েছে সেসকল আইন ও শাস্তির যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে।
বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ আইন এবং শাস্তি
বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন ২০১৭ অনুসারে বাল্যবিবাহ হচ্ছে একটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
-বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন ২০১৭ এর ৭ ধারা মোতাবেক যদি প্রাপ্ত বয়স্ক কোন নারী বা পুরুষ বাল্যবিবাহ করে তবে সে অনধিক ২ (দুই) বছরের কারাদণ্ড বা অনধিক ১ (এক) লক্ষ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডনীয় হবেন এবং অর্থদণ্ড অনাদায়ে অনধিক ৩ (তিন) মাস কারাদণ্ডে দণ্ডনীয় হবেন। অর্থাৎ,একজন প্রাপ্ত বয়স্ক, কিন্তু অন্য জন অপ্রাপ্ত বয়স্ক হয়, তাহলে এই বিধান তার জন্য প্রযোজ্য। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায় ছেলে প্রাপ্ত বয়স্ক কিন্তু মেয়ে অপ্রাপ্ত বয়স্ক সেক্ষেত্রে এই বিধান অনুযায়ী উক্ত ছেলেকে শাস্তি ভোগ করতে হবে।
-অপ্রাপ্ত বয়স্ক নারী বা পুরুষ বাল্যবিবাহ করলে সেক্ষেত্রে অনধিক ১(এক) মাসের আটকাদেশ বা অনধিক ৫০,০০০ (পঞ্চাশ) হাজার টাকা জরিমানা বা উভয় ধরনের শাস্তিযোগ্য হবেন। তবে ৮ ধারা মোতাবেক যদি কোন ব্যক্তির বিরুদ্ধে মামলাটি দায়ের করা হয় তবে অপ্রাপ্ত বয়স্ক নারী বা পুরুষ শাস্তি পাবে না তখন উক্ত ব্যক্তি শাস্তিযোগ্য হবেন এবং উপ-ধারা (২) এর অধীন বিচার ও শাস্তি প্রদানের ক্ষেত্রে অপ্রাপ্তবয়স্ক নারী বা পুরুষের উপর “শিশু আইন ২০১৩” এর বিধানাবলী প্রযোজ্য হবে।
-বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন ২০১৭ এর ৮ ধারা মোতাবেক, যদি পিতা-মাতা, অভিভাবক অথবা অন্য কোন ব্যক্তি অপ্রাপ্ত বয়স্ক কোনো ব্যক্তির উপর কর্তৃত্ব সম্পন্ন হয়ে বাল্যবিবাহ সম্পন্ন করার ক্ষেত্রে কোন কাজ করে থাকে অথবা করার অনুমতি প্রদান করে থাকে তবে তা অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হবে, যার শাস্তি হচ্ছে অনধিক ২(দুই) বছর ও অন্যূন ৬(ছয়) মাসের কারাদণ্ড বা অনধিক ৫০(পঞ্চাশ) হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডনীয় হবেন এবং অর্থদণ্ড অনাদায়ে অনধিক ৩(তিন) মাসের কারাদণ্ডে দণ্ডনীয় হবেন।
*লেখক: সেলিনা আক্তার সুইটি: রিসার্চ এক্সিকিউটিভ, জুরিস্টিকো।
আরো পড়ুন- বাংলাদেশে লিগ্যাল এইড সার্ভিস