BlogFeature

বাংলাদেশে লিগ্যাল এইড সার্ভিসের আদ্যোপান্ত

‘লিগ্যাল এইড’ বাংলাদেশ সরকারের এমন একটি উদ্যোগ, যার মাধ্যমে দেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে আইনগত সহায়তা প্রদান করা হয়। আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ এই লিগ্যাল এইড এমন লোকদের জন্য যারা দারিদ্রতার কারণে সাধারণত আইনের দ্বারস্থ হতে চায় না।

বাংলাদেশ সংবিধানের অনুচ্ছেদ ২৭ অনুযায়ী, সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী। কিন্তু যথেষ্ট পরিমান অর্থ না থাকার কারণে সমাজের নিম্নবর্গের মানুষজন,দরিদ্র ও নিপীড়িত জনগণ আইনের দারস্থ হতে পারে না, তাই এসব জনগোষ্ঠীকে আইনি সহায়তা দেওয়ার জন্যই প্রতিষ্ঠিত হয় লিগ্যাল এইড।

বাংলাদেশে ২০০৯ সালে আইনগত সহায়তা প্রদান সংস্থাকে একটি কার্যকর প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয় এবং প্রয়োজনীয় সংখ্যক কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ করা হয়। জেলা ও দায়রা জজের নেতৃত্বে দেশের ৬৪ টি জেলায় লিগ্যাল এইড কমিটি গঠন করা হয়। প্রত্যেক জেলার পাশাপাশি উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে লিগ্যাল এইড কমিটি গঠন করা হয়।

একজন সিনিয়র সহকারী জজ বা সহকারী জজ পদমর্যাদার বিচারক লিগ্যাল এইড অফিসার হিসেবে নিযুক্ত হন। এই লিগ্যাল এইড অফিসার পদটি সৃষ্টি করা হয়েছে আইনগত সহায়তা প্রদান আইন ২০০০ এর ২১(ক) ধারা বলে তবে তার দায়িত্ব ও কার্যাবলী নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে “আইনগত সহায়তা প্রদান (আইনি পরামর্শ ও বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি) বিধিমালা, ২০১৫ তে। এই বিধিমালা অনুযায়ী লিগ্যাল এইড অফিসারের দায়িত্ব রয়েছে:

১. বিচার প্রার্থীদের আইনি পরামর্শ দেয়া এবং

২. বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি (এডিআর) এর মাধ্যমে বিরোধ নিষ্পত্তি করা।

 

লিগ্যাল এইড অফিসার নিয়োগ দায়িত্ব:

(১) সরকার, বিধি দ্বারা নির্ধারিত পদ্ধতিতে, প্রয়োজনীয় সংখ্যক লিগ্যাল এইড অফিসার নিয়োগ এবং তাহাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য নির্ধারণ করিতে পারিবে।

২)লিগ্যাল এইড অফিসার আইনগত সহায়তা প্রার্থীকে আইনে পরামর্শ প্রদান করিতে পারিবে এবং প্রচলিত আইনের অধীন কোন আদালত বা ট্রাইব্যুনাল কর্তৃক উহার স্থানীয় অধিক্ষেত্রের আওতাধীন এলাকায় কর্মরত লিগ্যাল এইড অফিসারের নিকট বিকল্প পদ্ধতিতে বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য কোন বিষয় প্রেরণ করা হইলে উহা নিষ্পত্তির ক্ষমতা সংশ্লিষ্ট লিগ্যাল এইড অফিসারের থাকিবে।

লিগ্যাল এইড সংগঠনের বর্তমান পরিচালক – সিনিয়র জেলা জজ মোঃ সাইফুল ইসলাম। সুপ্রিম কোর্ট লিগ্যাল এইড কমিটির নতুন চেয়ারম্যান হয়েছেন বিচারপতি নাইমা হায়দার।

 

আইনগত সহায়তা প্রাপ্তির আবেদন প্রক্রিয়া: 

আইনগত সহায়তা পাওয়ার জন্য ২০০০ সালের আইনটির অধীন প্রতিষ্ঠিত সুপ্রীম কোর্ট কমিটি, জেলা কমিটি বা বিশেষ কমিটির নিকট আবেদন করতে হয়। এক্ষেত্রে “আইনগত সহায়তা প্রদান বিধিমালা, ২০১৫ এর ধারা ৩ এ আবেদন প্রক্রিয়ার বিস্তারিত দিকনির্দেশনা দেয়া হয়েছে। ধারা ৩ অনুযায়ী আইনগত সহায়তা পাওয়ার জন্য প্রত্যেক বিচার প্রার্থী তার নাম, পূর্ণ ঠিকানা এবং আইনগত সহায়তার কারণ উল্লেখ করে নির্ধারিত ফরমে আবেদন করবে। সেক্ষেত্রে, আপীল বিভাগ বা হাইকোর্ট বিভাগে বিচারের বিষয় হলে সুপ্রীম কোর্ট কমিটির চেয়ারম্যানের নিকট আবেদন করবে এবং অন্যান্য আদালতে বিচারের বিষয় হলে জেলা কমিটি বা ক্ষেত্রমতে বিশেষ কমিটির চেয়ারম্যানের নিকট আবেদন করবে। আবেদন প্রাপ্তির পর কমিটি একটি ক্রমিক নম্বর প্রদান করে নির্দিষ্ট রেজিস্টারে আবেদনপত্রের বিবরণ লিপিবদ্ধ করবে এবং বিচার প্রার্থীকে একটি প্রাপ্তি রশিদ প্রদান করবে। উল্লেখ্য, একজন আবেদনকারী বিচার প্রার্থীর দায়িত্ব, মামলা পরিচালনা করার জন্য আইনজীবী মনোনয়ন, আইনজীবীদের ফি, মামলার প্রাসঙ্গিক খরচ সম্পর্কেও উক্ত বিধিমালায় সুনির্দিষ্ট দিকনির্দেশনা লিপিবদ্ধ করা হয়েছে।

লিগ্যাল এইড সার্ভিসের আদ্যোপান্ত

জাতীয় আইনগত সহায়তা কমিটির কাজ –

সবার জন্য ন্যায়বিচারের সমান প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করা, ন্যায়বিচারের পথ সুগম করা। দরিদ্র জনগণকে আইন অনুযায়ী উচ্চমানের আইনি সহায়তা প্রদান । দুঃস্থদের আইনি সহায়তা দিতে জাতীয় হেল্পলাইন চালু করা হয়েছে। ১৬৪৩০ নম্বরে ডায়াল করে বিনামূল্যে আইনি সহায়তা নিতে পারেন দরিদ্র ও দুঃস্থরা।

২৭ এপ্রিল ২০২৪ বাসস জানিয়েছে, জাতীয় আইনগত সহায়তা সংস্থা মাধ্যমে ২০০৯ সাল থেকে ২০২৪ সালের মার্চ পর্যন্ত ১০ লাখ ২২ হাজার ৯৫৮ জনকে সরকারি খরচায় আইনি সহায়তা দেয়া হয়েছে। অসচ্ছল বিচারপ্রার্থীদের ১৮৭ কোটি ৪৪ লাখ ৬১ হাজার ৬৮৭ টাকা ক্ষতিপূরণ আদায় করে দিয়েছে জাতীয় আইনগত সতায়তা সংস্থা।

প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, লিগ্যাল এইডে আইনি সহায়তা দেয়া হয়েছে মোট ৩ লাখ ৮৪ হাজার ৮৮৬ মামলায়। এর মধ্যে আইনি সহায়তার মাধ্যমে ১ লাখ ৯৪ হাজার ১২২টি মামলা নিস্পত্তি হয়েছে। বিকল্প বিরোধ নিস্পত্তি সেবার মাধ্যমে লিগ্যাল এইডে মামলা নিস্পত্তি হয়েছে ১ লাখ ১২ হাজার ৯১৩টি। এডিআর এর জন্য উদ্যোগ নেয়া হয়েছে ১ লাখ ২৪ হাজার ৯৫৮টি মামলায়। এ সময়ের মধ্যে আইনি পরামর্শ সেবা দেয়া হয়েছে ৪ লাখ ৫ হাজার ৯২টি মামলায়।

 

লিগ্যাল এইড এর ভবিষ্যৎ পরিকল্পন –

১. সংস্থাকে পরিচালকের কার্যালয় হতে মহাপরিচালকের কার্যালয়ে রুপান্তর করা।

২. ৬৪ টি জেলায় পুর্ণকালীন জেলা লিগ্যাল এইড অফিসার নিয়োগ।

৩. সামগ্রিক ভাবে জেলা লিগ্যাল এইড অফিসের সক্ষমতা বৃদ্ধি।

৪. বার কাউন্সিল, বার এসোসিয়েশন, জেলা তথ্য অফিস, এনজিও ও গণমাধ্যমকে সরাসরি আইনি সহায়তা কার্যক্রমে সম্পৃক্তকরণ।

৫. কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক কারিকুলামে লিগ্যাল এইডকে পাঠ্যসূচী হিসেবে অন্তর্ভুক্তিকরণ ইত্যাদি।

সরকার ২০১৩ সালের ২৮ এপ্রিলকে ‘জাতীয় আইনগত সহায়তা দিবস’ ঘোষণা করেছে। সকল মানুষের বিচার অধিকার প্রতিষ্ঠায় সরকারের আইনগত সহায়তা কার্যক্রম প্রচারের মাধ্যমে ব্যাপক উৎসাহ উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে এই দিবসটি প্রতিবছর পালন করা হয়।

*লেখক- ইসরাত জাহান রিয়া: ইনফো এন্ড পাবলিক রিলেশন এক্সিকিউটিভ, জুরিস্টিকো।

 

 

আরও পড়ুন- আইন বিষয়ে পড়াশোনা ও ক্যারিয়ার

 

You cannot copy content of this page