আইনজীবী সনদ পরীক্ষার সংস্কার আন্দোলন নিয়ে…
আইন পেশা একটি মহান পেশা, আগেরকার দিনের রাজা-জমিদারের ছেলেমেয়েরা বিদেশ থেকে পড়ালেখা করে আইন পেশায় যুক্ত হতো! বর্তমানে এই পেশা আর রাজা বা জমিদারের ছেলেমেয়ে মধ্যের সীমাবদ্ধ নেই, এখন যে কেউ চাইলেই এই পেশার সাথে সংযুক্ত হতে পারে। শহর, নগর, মফস্বল এলাকাসহ যেকোনো শ্রেনীর মানুষ এই পেশার সাথে সম্পৃক্ত। আইন পেশা শুধু একটি পেশা নয়! গরীব, সুবিধাবঞ্চিত মানুষদের পাশে দাঁড়ানোর একটা মাধ্যমও বটে। এই পেশায় সুনাম, প্রতিপত্তি, টাকা যেমন আছে, তেমনি কতিপয় পেশাজীবীদের জন্য এর দুর্নামও লোক মুখে কম শুনতে পাওয়া যায় না। মাঝে মাঝে এটাও শুনতে পাওয়া যায়, ” যার কোনো নাই গতি, সে করে ওকালতি।”
একজন ব্যক্তি আইনপেশায় যুক্ত হতে হলে তাঁকে কোনো একটি আইনজীবী সমিতির সদস্য হতে হয়, আইনজীবী সমিতির হতে হলে তাঁকে অবশ্যই বার কাউন্সিল কর্তৃক প্রদত্ত আইনজীবী তালিকাভুক্তি সার্কুলার অনুযায়ী ফর্ম পূরণ করে, যথাক্রমে প্রিলিমিনারি, লিখিত এবং মৌখিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হয়।
বার কাউন্সিল কর্তৃক পরীক্ষা পদ্ধতি পরিবর্তন করে আগের থেকে কিছুটা কঠিন করা হয়, যার ফলে বৈষম্য বিরোধী শিক্ষানবিশ আইন ছাত্র সমাজের ব্যানারে পরীক্ষা পদ্ধতি সংস্কারের জন্য ৫ দফা দাবি ওঠেছে। সেগুলো হলো:-
১. MCQ ও ভাইবা পরীক্ষা হতে হবে, লিখিত পরীক্ষা বাতিল করতে হবে।
২.প্রতি বছর দুটি পরীক্ষা নিতে হবে।
৩. MCQ পাস নাম্বার ৪০ করতে হবে, কোনো কাট মার্ক থাকবে না।
৪. কোনো পরীক্ষার্থী একবার MCQ এ পাস করলে, দ্বিতীয়বার MCQ পরীক্ষা দেওয়া লাগবে না।
৫. এটি যেহেতু চাকরির কোনো প্রতিযোগিতা নয়, সেহেতু জুডিশিয়াল সার্ভিসের ন্যায় পরীক্ষা পদ্ধতি গ্রহণ যোগ্য হবে না।
প্রথমত- বর্তমানে আইন পেশা একটি জনপ্রিয় পেশা হওয়ায়, রাজনীতিবিদ, সমাজকর্মী থেকে শুরু করে বিভিন্ন চাকরিজীবীও এই পেশায় ঝুঁকে যাচ্ছে! ফলস্বরূপ অনেক সময় আদালতে আইনজীবীর সংখ্যা বেশি উপলব্ধি করা যাচ্ছে! এখন যদি লিখিত পরীক্ষা বাদ দিয়ে দেওয়া হয়, তাহলে ৫ বছর পর বাংলাদেশে কি পরিমাণ অ্যাডভোকেট তালিকাভুক্ত হবে তা হয়তো ক্যালকুলেটক দিয়ে হিসেব করেও বের করা যাবে না!
দ্বিতীয়ত- MCQ ৭টি আইনের উপরে ১০০ নাম্বারের পরীক্ষা হয়ে থাকে সেখানে কোনো পরীক্ষার্থী যদি ৫০ নাম্বার না পায় তাহলে তিনি আইন পেশায় এসে কি করবেন সেটা আমার জানা নাই! তবে কাট মার্ক বাদ দেওয়া যেতে পারে।
তৃতীয়ত- একবার MCQ পাস করলে দ্বিতীয়বার লিখিত এবং একবার লিখিত পাস করলে দ্বিতীয়বার মৌখিক পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ দেওয়া যেতে পারে, তবে তৃতীয়বার নয়।
চতুর্থত, অ্যাডভোকেট তালিকাভুক্তি কোনো চাকরির পরীক্ষা নয়, এটি একটি পেশা। বর্তমান এই পেশায় মানুষের প্রবল আগ্রহের কারণেই পরীক্ষা পদ্ধতি কঠিন করা হয়েছে। পেশার ভারসাম্য রক্ষার জন্যই এই উদ্যোগ নেয়া, যেনো এটা সহজলভ্য না হয়। তাই পরীক্ষার বর্তমান মান বজায় রাখতে বার কাউন্সিল পরীক্ষা অবশ্যই জুডিসিয়াল সার্ভিস পরীক্ষার আদলেই গ্রহণ করা।
এমন একটা সময় ছিলো যখন কোনো ব্যক্তি বার কাউন্সিল তালিকাভূক্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতো সে তালিকাভুক্ত হয়ে যেত! কিন্তু এই প্রবণতা এখন অনেকটাই হ্রাস পেয়েছে।
বার কাউন্সিল কিছু বিষয় নজরে আনতে পারে-
১. নিয়মিত পরীক্ষার ব্যবস্থা।
২. শিক্ষানবিশ আইনজীবীদের হতাশা দূরীকরণের লক্ষ্যে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ২ বছরের কোর্স পরিবর্তন করে ৪ বছর করা।
৩. লিখিত পরীক্ষায় সর্বোচ্চ স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা।
৪. আইন বিভাগে ভর্তির জন্য বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ শিক্ষার্থীদের জন্য নূন্যতম পয়েন্ট নির্ধারণপূর্বক ভর্তি পরীক্ষা দ্বারা ভর্তি নেয়া।
৫. বার কাউন্সিল সনদ পরীক্ষায় সাংবিধানিক আইনসহ সম্পত্তি সংক্রান্ত আইন অন্তর্ভুক্ত করা।
৬. আইনপেশার মান উন্নয়নে বার কাউন্সিল অন্যান্য যেকোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেন।
গনতান্ত্রিক রাষ্ট্রে আন্দোলন করার অধিকার সবারই আছে তবে আমরা যারা সচেতন আইনের ছাত্র এবং শিক্ষানবিশ আইনজীবী আছি তাদের দাবি একটাই হোক, “প্রকৃত যোগ্যরাই এই পেশায় আসুক, পেশার সৌন্দর্য টিকে থাকুক।”
*লেখক- নাজমুল প্রান্ত: রিসার্চ এক্সিকিউটিভ, জুরিস্টিকো।