ধর্ষকের পক্ষে আইনজীবী দাঁড়ানোর যৌক্তিকতা
ধর্ষকের পক্ষে আইনজীবী দাঁড়ানোর যৌক্তিকতা
ফৌজদারি বিচার প্রক্রিয়ায় তিনটি পক্ষ হলো বিচারক, রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী এবং আসামি পক্ষের আইনজীবী। এই তিনটি আবশ্যক পক্ষ ছাড়া যদি কোনো বিচারকার্য সম্পন্ন করা হয় তাহলে সেটি ন্যায়বিচার বলে গণ্য হবে না । কোনো আসামীকে আত্মপক্ষ সমর্থন হতে বঞ্চিত করা যাবে না, যদি বঞ্চিত করা হয় তাহলে সেটা হবে ন্যায়বিচারের পরিপন্থী । A fundamental principle of natural justice is that, “no man should be condemned unheard”, আসামীকে আইনজীবীর মাধ্যমে আত্মপক্ষ সমর্থনের বাধা প্রদান বিচারব্যবস্থাকে অস্বীকার করার সমান।
১৯৪৮ সালে গৃহীত জাতিসংঘের মানবাধিকারের সার্বজনীন ঘোষণাপত্রের অনুচ্ছেদ ১১(১) তে বলা হয়েছে, “ফৌজদারি অপরাধে অভিযুক্ত প্রত্যেক ব্যক্তির আত্মপক্ষ সমর্থনের প্রয়োজনীয় নিশ্চয়তা দিয়ে আদালতের বিচারে আইন অনুসারে দোষী প্রমাণিত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত নির্দোষ হিসেবে গণ্য হওয়ার অধিকার রয়েছে”।
বাংলাদেশ সংবিধানেও অভিযুক্তকে সুরক্ষা প্রদান করা হয়েছে, গ্রেপ্তারকৃত কোন ব্যক্তিকে যথাসম্ভব তার গ্রেপ্তারের কারণ জানাতে হবে, উক্ত ব্যক্তিকে এরূপ কারণ না জানিয়ে আটক রাখা যাবে না এবং উক্ত ব্যক্তিকে তার মনোনীত আইনজীবীর সাথে পরামর্শের ও তার দ্বারা আত্মপক্ষ সমর্থনের অধিকার থেকে বঞ্চিত করা যাবে না।( বাংলাদেশ সংবিধান-অনুচ্ছেদ ৩৩(১))
১৮৯৮ সালের ফৌজদারী কার্যবিধির (CrPC) ধারা ৩৪০ অনুসারে একজন আসামি তার পক্ষে আইনজীবী নিয়োগ করার অধিকার রাখেন।
“অসংখ্য অপরাধী ছাড়া পেয়ে গেলেও, একজন নির্দোষ ব্যক্তিকেও শাস্তি প্রদান করা যাবে না”
নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যালের বিচারক এবং অন্যান্য আইনজীবী ও আইনজ্ঞ এবং মানবাধিকারকর্মীদের মতে ধর্ষণের বেশিরভাগ মামলাই মিথ্যা এবং তা উদ্দেশ্য প্রনোদিতভাবে করা হয়। কখনো কখনো কখনো ধর্ষণ মামলার বিচারকার্য শেষ হওয়ার পরে দেখা যায় সেখানে নূন্যতম শ্লীলতাহানির অপরাধও সংঘটিত হয় নাই! সেক্ষেত্রে ধর্ষণে অভিযুক্তর পক্ষে যদি কোনো আইনজীবী না দাঁড়ায় তাহলে নির্দোষ ব্যক্তিও দণ্ড পেয়ে যাবে। যা ন্যায়বিচারের পরিপন্থী।
২০০০ সালের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনটি বাংলাদেশ সংবিধানের অনুচ্ছেদ ২৮(৪) অনুসারে প্রণয়ন করা হয়েছে। যা নারী ও শিশুকে বিশেষ নিরাপত্তা দেওয়ার প্রেক্ষিতে জাতীয় সংসদ কর্তৃক প্রণয়ন করা হলেও দেশের প্রেক্ষাপটে বেশিরভাগ নারীই তা ঢাল হিসাবে ব্যবহার করছে। যা উক্ত আইনের স্পষ্ট অপব্যবহার। কখনো কখনো দেখতে পাওয়া যায় অন্য আইন অনুসারে কোনো ব্যক্তি অপরাধ সংগঠিত করেছে বা সাধারণ বাকবিতন্ডায় জড়িয়েও নারীরা এই আইন অনুসারে মামলা দায়ের করে, কারণ এই আইন অনুসারে জামিন পেতে হলে অনেক বেগ পেতে হয়।
ইকুইটির একটি ম্যাক্সিম হলো “innocent until proven guilty” মানে হচ্ছে, অপরাধ প্রমাণিত না হওয়া কাউকে দোষী বলা যাবে না। অথচ আজকাল ধর্ষণের অভিযোগে অভিযুক্ত ব্যক্তির পক্ষে আইনজীবী দাঁড়ালেও তাকে জনগণের তোপের মুখে পড়তে হয়! যা দণ্ডবিধি অনুসারে ফৌজদারি অপরাধ।
আমি চাই ধর্ষকের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হোক, যেনো পরবর্তী ধর্ষণের ভয়াবহতার জন্য এই প্রবণতা থেকে বেরিয়ে আসে। কিন্তু কারও বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ করা হলেই বিচারবহির্ভূতভাবে মব করতে হবে! যে উক্ত অভিযুক্তের পক্ষে কোনো আইনজীবী দাঁড়ালে তার উপরেও হামলা করা বাংলাদেশ সংবিধান এবং প্রচলিত সকল আইনের পরিপন্থী এবং ন্যায়বিচারের অন্তরায়। যদি এমনভাবেই চলতে থাকে তাহলে ধর্ষণের অভিযুক্ত ব্যক্তির পক্ষে কোনো আইনজীবী দাঁড়ানোর সাহস পাবে না, তাতে করে অনেক নির্দোষ ব্যক্তিও শাস্তির আওতায় চলে যাবে এবং স্বার্থলোভী কিছু নারীরা এই আইনের মাধ্যমে পুরুষদের কোনঠাসা করে রাখবে, যা শুধু ন্যায়বিচারের জন্যই নয় পুরো সমাজব্যবস্থার জন্যই হুমকিস্বরূপ।
*লেখক: নাজমুল প্রান্ত, কন্ট্রিবিউটর, জুরিস্টিকো ব্লগ।