BlogFeatureHome

জেলা প্রশাসকের দায়দায়িত্ব ক্ষমতা ও কার্যাবলি

বাংলাদেশের আমলাতন্ত্রে জেলা প্রশাসন মৌলিক ও প্রাথমিক একক। জেলা প্রশাসনের শাসনভার একজন জেলা প্রশাসক বা ডেপুটি কমিশনারের ওপর ন্যস্ত থাকে। তিনি বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসের প্রশাসন ক্যাডারের (যা বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস নামে পরিচিত) গ্রেড-৫[২] এর সদস্য ও সরকারের একজন গুরুত্বপূর্ণ আমলা। তিনি একই সাথে ডেপুটি কমিশনার, জেলা কালেক্টর ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেট। জেলা প্রশাসক মন্ত্রী পরিষদের একজন প্রতিনিধি। তিনি তার কাজের জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে জবাবদিহিতা করেন।

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় কার্যবিধিমালা ১৯৯৬ এর তফসিল ৫ অনুসারে জেলা প্রশাসক নিয়োগ, পদায়ন ও বদলি করে থাকে। মন্ত্রিপরিষদ সচিবকে সভাপতি ও জনপ্রশাসন, ভূমি ও স্বরাষ্ট্র সচিবদের সদস্য করে গঠিত কমিটি নিয়োগের কাজ করে। তবে জেলা প্রশাসকদের মূল নিয়ন্ত্রণ করে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ।

স্বাধীনতার অব্যাহতির পরেই বাংলাদেশে বিভিন্ন প্রান্তে ইতিবাচক ও দৃশ্যমান উন্নয়ন প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করার জন্য বাংলাদেশের জেলা প্রশাসন মৌলিক পরিবর্তন আনার প্রচেষ্টা শুরু করে। এর ধারাবাহিকতায়  ১৯৭৩ সালে প্রশাসনিক ও চাকরির পূর্ণ বিন্যাসে বাংলাদেশের জেলা প্রশাসনকে নতুন করে পুনর্গঠনের প্রস্তাব করা হয়। এ প্রস্তাব অনুযায়ী প্রয়োজনীয় ভৌগোলিক ও আঞ্চলিক পুনর্বিন্যাসের পর প্রতিটি মহুকুমা একটি জেলায় রূপান্তরিত হয়। প্রয়োজন বোধে একটি বড় মহকুমাকে ভেঙে একাধিক জেলা ও ছোট ছোট কয়েকটি মহকুমা একত্রিত করে একটি জেলা গঠন করা হয়। পরবর্তীকালে ১৯৮৪ সালে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি এক আদেশ বলে  দেশের ১৯ টি জেলার পরিবর্তে ৬১টি জেলা প্রতিষ্ঠিত করার উদ্দেশ্যে এক ঘোষণা জারি করেন।

এই ধারাবাহিকতায় আজকের বাংলাদেশে জেলার সংখ্যা ৬৪ টি। প্রতিটি জেলায় একজন জেলা প্রশাসক নিয়োগ করা হয়।

 

জেলার যাবতীয় কার্যাবলী সম্পাদনে জেলা প্রশাসক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। জেলা প্রশাসকের কার্যাবলী আলোচনা করা হলো:

জনশৃঙ্খলা ও জননিরাপত্তা রক্ষা: রাজনৈতিক সংঘাত ও উত্তেজনা, দাঙ্গা, বিশৃঙ্খলা, হরতাল, শ্রমিক অসন্তুষ্টি ইত্যাদি জরুরি পরিস্থিতির সময় জনশৃঙ্খলা বিধানের দায়িত্ব পালন করেন জেলা প্রশাসন তথা জেলার মুখ্য আমলা জেলা প্রশাসক।

বিবাদমান পক্ষের মধ্যে শান্তি শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য  ১৮৯৮ সালের ফৌজদারী কার্যবিধির ১১৪ ধারার মতে ব্যবস্থা গ্রহণ; গুন্ডা, টাউট, সন্ত্রাসদমন এবং মাদক  ব্যবসা ইত্যাদি নিয়ন্ত্রণ; ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইন মোতাবেক অপরাধের মাত্রা অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে প্রদান; সরকারি সম্পত্তির দখল পুনরুদ্ধার সংক্রান্ত কার্যক্রম; এসিড ও মাদকের অপব্যবহার রোধ, নারী ও শিশু নির্যাতন রোধ, বাল্যবিবাহ রোধ, যৌতুক নিরোধ, জঙ্গিবাদ দমন নারী ও শিশু পাচার রোধ, জাল নোট প্রচলন রোধ এবং যৌন হয়রানি প্রতিরোধের মতো গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করে জেলা প্রশাসক।

আইন শৃঙ্খলার রক্ষা : জেলার আইন শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব জেলা প্রশাসকের ন্যস্ত থাকে। ১৮৬১ সালের পুলিশ আইন এবং ১৯৪৩ সালের পুলিশ রেগুলেশনস অনুযায়ী অপরাধ দমন কার্যক্রমে পুলিশ বিভাগের উপজেলা প্রশাসনের সাধারণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত রয়েছে।

এছাড়াও সংক্রান্ত বিশেষ পরিস্থিতি, প্রাণহানি দুর্ঘটনা দুর্যোগ ইত্যাদি বিষয়ে সরকারের আশু দৃষ্টি আকর্ষণ করে তাৎক্ষণিক প্রতিবেদনও প্রেরণ করে জেলা প্রশাসন।

দুর্নীতি প্রতিরোধ : স্বাধীন বাংলাদেশের বড় সমস্যাসমূহের  মধ্যে একটি হচ্ছে দুর্নীতি। যা প্রতিরোধে আমলাতন্ত্রের মধ্যে জেলা প্রশাসক মুখ্য ভূমিকা পালন করে। সরকারের একজন দক্ষ অফিসার হিসেবে দুর্নীতি প্রতিরোধে দুর্নীতি দমন কমিশনকে সর্বাত্মক সহযোগিতা প্রদান এবং জনগণ কর্তৃক দাখিলকৃত দুর্নীতি বিষয়ে অভিযোগে তদন্ত প্রক্রিয়া সৃষ্টি করাসহ দুর্নীতি প্রতিরোধে সচেতনতা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে সম্পৃক্ততা বাড়ানো ও কার্যকরী করা জেলা প্রশাসকের দায়িত্ব।

খাদ্য ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা: জেলা প্রশাসক খাদ্যশস্য গুদামজাত করণে দায়িত্ব পালন করেন। খাদ্যশস্যের মূল্য স্থিতিশীল রাখা ও লাইসেন্স প্রদান, খাদ্য নিরাপত্তা গড়ে তোলা, খাদ্যে ভেজাল প্রতিরোধে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করা এবং খাদ্য বিক্রয় কর্মসূচি তত্ত্বাবধান করে থাকেন। তাছাড়া দুর্ভিক্ষ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত স্থায়ী আদেশ ও নীতিমালা, বিভিন্ন পরিচয়পত্র, প্রজ্ঞাপন, আদেশ ও নির্দেশনা অনুযায়ী দুর্যোগ কালীন ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ পরিচালনা করেন। দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা তাৎক্ষণিক পরিদর্শন, দরিদ্রের জন্য কর্মসৃজন ও বাস্তবায়ন, ভিজিএফ/ভিজিডি বাস্তবায়ন এবং সরকার কর্তৃক বিভিন্ন সময় বিভিন্ন কর্মসূচির বাস্তবায়ন ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা সম্পর্কিত সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি তত্ত্বাবধান করেন।

যুব, ক্রীড়া ও নাগরিক বিনোদনে ভূমিকা : নাগরিক বিনোদনের ক্ষেত্রে ১৯১৮ সালের সিনেমাটোগ্রাফি আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ ও পরিচালনা, বিনোদন কর পরিহার, বিদ্যমান বিনোদন স্থানসমূহ নিরাপদ ও পরিচ্ছন্ন বিনোদন নিশ্চিতকরণে উদ্যোগ গ্রহণ, শুধু দেশীয় সংস্কৃতির সাথে সঙ্গতিপূর্ণ যাত্রা, সার্কাস  প্রদর্শনী, নাটক অনুষ্ঠানের অনুমতি প্রদান, অশ্লীল  বিনোদন নিয়ন্ত্রণ, দেশীয় সংস্কৃতি প্রসারে সহায়তা প্রদান  এবং ক্যাবল টিভি আইন ২০০৮ অনুযায়ী ক্যাবল টিভি পরিচালনার অনুমোদন প্রদান করাও জেলা প্রশাসকের কার্যাবলীর অন্তর্ভুক্ত।

 

একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের উন্নয়ন ত্বরান্বিত করার  জন্য আমলাতন্ত্রের মধ্যে জেলা প্রশাসন অন্যতম। বাংলাদেশ ৫ ই আগস্ট ২০২৪ এ স্বৈরাচার থেকে মুক্ত হয়। পুনরায় নবীন বাংলাদেশকে বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে একটি সুষ্ঠ এবং দুর্নীতিমুক্ত জেলা প্রশাসন অনবদ্য ভূমিকা পালন করবে।

*লেখক- নুসরা প্রজ্ঞা: এক্সিকিউটিভ মেম্বার, জুরিস্টিকো।

 

আরো পড়ুন- ন্যায়পালের দায়দায়িত্ব ও কার্যাবলি

 

You cannot copy content of this page