পিআর পদ্ধতির নির্বাচন: বাংলাদেশ প্রেক্ষিত
বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাস গণতন্ত্র ও নির্বাচন নিয়ে বহু চড়াই-উতরাইয়ের সাক্ষী। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্মই হয়েছে সুষ্ঠু ও সুশৃঙ্খল নির্বাচন কেন্দ্রীক গণতান্ত্রিক চাহিদার ঘটনাবলির মধ্য দিয়ে। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থার প্রতিষ্ঠা হলেও তা কখনো একদলীয় শাসন, কখনো সামরিক শাসন আবার কখনো দলীয় দ্বন্দ্বে জর্জরিত হয়ে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা বারবার মুখ থুবড়ে পড়েছে। প্রতিবারই ক্ষমতায় থাকা দলগুলো তাদের ক্ষমতার মসনদ দীর্ঘস্থায়ী করতে নিজেদের ইচ্ছামত সংবিধান কাটাছেঁড়া করেছে। এই পালাবদলের প্রেক্ষাপটে অংশগ্রহণমূলক, প্রতিনিধিত্বমূলক ও ন্যায়সঙ্গত নির্বাচনের দাবি ছিলো দীর্ঘদিনের। ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ছাত্র জনতার গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর শেখ হাসিনার দীর্ঘ সাড়ে ষোল বছরের ফ্যাসিবাদী শাসনের তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকে এদেশের রাজনৈতিক মহল রাষ্ট্র ব্যবস্থা সংস্কারের জন্য দিকে জোর দেন। রাষ্ট্রকে ঢেলে সাজানোর জন্য গঠন করা হয় জাতীয় ঐক্যমত্য কমিশন। কমিশন গণঅভ্যুত্থানের অংশীদারী রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে রাষ্ট্র ব্যবস্থা সংস্কার নিয়ে আনুষ্ঠানিক বৈঠক করে। বৈঠকে নির্বাচন পদ্ধতি সংষ্কারের বিষয়টি সর্বাপেক্ষা আলোচ্য বিষয়ে পরিণত হয়।
বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বর্তমানে “প্রথম আসন পদ্ধতি” (First Past the Post) অনুসরণ করা হয়, যেখানে প্রতিটি আসনে যে প্রার্থী সর্বাধিক ভোট পায়, সেই প্রার্থীই সেই আসনের সংসদ সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হন, যদিও অনেক ক্ষেত্রে নির্বাচিত প্রার্থী মোট ভোটের ৩০-৪০% পেয়েও নির্বাচিত হন, কারণ বাকি ভোট বিভক্ত থাকে অন্যান্য প্রার্থীদের মাঝে। এতে করে নির্বাচনের ফলে প্রকৃত জনমতের প্রতিফলন হয় না।
এরই পরিপ্রেক্ষিতে আলোচনায় উঠে আসে সংখ্যানুপাতিক নির্বাচন ব্যবস্থা। সংখ্যানুপাতিক নির্বাচন ব্যবস্থা (Proportional Representation বা PR) হলো এমন একটি নির্বাচন পদ্ধতি, যেখানে রাজনৈতিক দলসমূহ যত শতাংশ ভোট পায়, সংসদে ঠিক তত শতাংশ আসন তারা পায়। অর্থাৎ, কোনো দল ১০% ভোট পেলে দলটি সংসদের মোট আসনের ১০% পাবে। যেমন, সংসদে যদি ৩০০ আসন থাকে এবং কোন দল যদি সারাদেশে ১% ভোট পায় তাহলে সেই দল সাংসদে ৩ টি আসন পাবে। এতে চাইলেই সংখ্যাগরিষ্ঠ না হয়ে সংসদে প্রতিনিধিত্ব অর্জন করা সম্ভব। এটি বহুদলীয় মত প্রকাশ ও প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করে।
বাংলাদেশে দীর্ঘদিন ধরে মূলত দুটি প্রধান দল পালাবদল করে ক্ষমতায় আসছে। সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতি ছোট দল ও নবীন রাজনৈতিক শক্তিগুলোকে সংসদে প্রতিনিধিত্ব করার জন্য সুযোগ তৈরি করে দিতে পারে। কোন দল যদি সারাদেশ থেকে ২০% ভোট পায়, অথচ সংসদে কোনো আসন না পায়—এটা জনমতের প্রতি অবিচার। পিআর পদ্ধতি এই বৈষম্য দূর করতে পারে। যেহেতু পিআর পদ্ধতিতে সব দল কিছু না কিছু আসন পায়, তাই সংসদে আলোচনা, বিতর্ক ও মতবিনিময়ের সুযোগ বাড়ে। একতরফা আইন পাশ করার প্রবণতা কমে যায়।
পিআর পদ্ধতি গণপ্রতিনিধিত্বশীল হলেও তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর জন্য তা অত্যন্ত জটিল ও ঝুঁকিপূর্ণ। কারণ সংখ্যানুপাতিক ব্যবস্থায় একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে, ফলে জোট সরকার গঠন হয়। এটি যদি দুর্বল হয় তবে নীতিগত সিদ্ধান্ত গ্রহণে সমস্যা দেখা দেয়। ফলে ঘনঘন সরকার পরিবর্তন ঘটে এবং রাজনৈতিক অস্থিরতা তৈরি হয়। তাছাড়া ছোট ছোট মৌসুমি দলও সংসদে আসন পেয়ে ক্ষমতার ভাগ চাইতে পারে, যার ফলে হোস্টেজ পলিটিক্স বা জোট জিম্মিদশার সৃষ্টি হয়।
বাংলাদেশের বেশিরভাগ সাধারণ মানুষ পিআর পদ্ধতি সম্পর্কে অবগত নয়। এছাড়া বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশন ও প্রশাসনিক কাঠামো এখনও FPTP (First Past The Post) পদ্ধতির উপযোগী। পিআর পদ্ধতি বাস্তবায়নে নতুন ধরনের ব্যালট, গণনা পদ্ধতি ও রাজনৈতিক শিক্ষার প্রয়োজন যা বর্তমানে অনুপস্থিত।
হঠাৎ করে সম্পূর্ণ নতুন একটি পদ্ধতি চালু করলে রাষ্ট্র নানান ধরনের সমস্যার মুখোমুখি হতে পারে। তাই পিআর পদ্ধতি সীমিত আকারে চালু করা যেতে পারে যাকে মিক্সিড মেম্বার প্রোপোর্শন (MMP) পদ্ধতি বলা হয়। জার্মানি, নিউজিল্যান্ড ও স্কটল্যান্ডের মতো দেশগুলোতে এধরনের মিশ্র পদ্ধতি অনুসরণ করছে এবং তারা সফলও হয়েছে।
মিক্সড মেম্বার প্রোপোরশনাল (MMP) ব্যবস্থা হলো কিছু আসনে সরাসরি ভোটে (FPTP) এবং কিছু আসন পিআর অনুযায়ী ভাগ করা হয়। এতে সরাসরি যোগাযোগ ও প্রতিনিধিত্বের ভারসাম্য বজায় রাখা যায়।
বাংলাদেশে প্রথম অবস্থায় মিক্সড মেম্বার প্রোপোরশনাল (MMP) পদ্ধতি চালু করা যেতে পারে। এক্ষেত্রে সংসদের মোট আসন ৩৫০ রাখা যেতে পারে, যেখানে ২০০ আসন সরাসরি ভোটে এবং ১৫০ আসন পিআর অনুযায়ী নির্ধারণ করা হবে। ১৫০ আসন ঘুর্নায়মান পদ্ধতিতে হতে পারে। যেমন- আসন্ন ত্রয়োদশ নির্বাচনে রংপুর ও রাজশাহী বিভাগে পিআর পদ্ধতি প্রয়োগ করা হলে পরেরবার অর্থ্যাৎ চতুর্দশ সংসদ নির্বাচনে খুলনা বরিশাল, তার পরের বার চট্টগ্রাম কুমিল্লায় পিআর পদ্ধতি প্রয়োগ করা যেতে পারে। জাতীয় ঐক্যমত্য কমিশনে প্রস্তাবিত জাতীয় সংসদের উচ্চকক্ষে আগামী নির্বাচনে পিআর পদ্ধতি প্রয়োগ হলে তা রাষ্ট্র সংস্কারের গুগুত্বপূর্ণ অগ্রগতি বলে মনে করা যাবে।
পিআর আসনের ক্ষেত্রে জাতীয়ভাবে ভোট গণনা হবে এবং রাজনৈতিক দলগুলো তালিকা জমা দেবে। একটি নির্দিষ্ট ন্যূনতম ভোটপ্রাপ্তির হার (যেমন ৫%) নির্ধারণ করা যেতে পারে, যাতে অতিরিক্ত দল সংসদে ঢুকে বিশৃঙ্খলা না করে। যদি মিশ্র পদ্ধতির পিআর চালু করা হয় তাহলে সংখ্যালঘু ও নারীদের প্রতিনিধিত্ব বাড়বে, ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষা হবে, ভোটদানের হার বাড়বে এবং রাজনৈতিক সহনশীলতা বৃদ্ধি পাবে।
সংখ্যানুপাতিক নির্বাচন পদ্ধতি বাংলাদেশের জন্য এক অলীক কল্পনা নয় বরং ভবিষ্যতের বাস্তবতা হয়ে উঠতে পারে, যদি রাজনৈতিক সদিচ্ছা, জনসচেতনতা ও প্রশাসনিক প্রস্তুতি থাকে। আমাদের রাজনৈতিক ব্যবস্থায় একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক, প্রতিনিধিত্বমূলক ও জবাবদিহিমূলক সংসদ গঠন এখন সময়ের দাবি। সেই লক্ষ্যে সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতি নিয়ে এখনই জাতীয় পর্যায়ে আলোচনা শুরু হওয়া জরুরি।
সর্বোপরি গণতন্ত্র কেবল ভোট দেয়ার নাম নয় বরং জনগণের প্রকৃত মতকে সংসদে প্রতিফলিত করার নাম। সংখ্যানুপাতিক নির্বাচন ব্যবস্থা হতে পারে সেই সেতুবন্ধন, যেখানে প্রতিটি ভোটের প্রকৃত মূল্যায়ন হবে।
*লেখক: রোমন তালুকদার- সাব-এডিটর, জুরিস্টিকো ল ব্লগ।
আরও পড়ুন- রাজসাক্ষীর বিধি-বিধান ও সুযোগ সুবিধা
