ভারতে পাশ হলো বিতর্কিত ওয়াক্ফ বিল
ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের আইনসভার নিম্মকক্ষ লোকসভায় পাশ হলো ওয়াক্ফ বোর্ড ১৯৯৫ এর সংশোধনী (Amendment) বিল। গতকাল ৩ এপ্রিল মধ্যরাতে (বুধবার দিবাগত রাত) এ বিল পাশ হয়। ২০২৪ সালের ৮ আগস্ট লোকসভায় উত্থাপিত এ বিলে উক্ত আইনের নাম রাখা হয়েছে “একীভূত ওয়াকফ ব্যবস্থাপনা, ক্ষমতায়ন, দক্ষতা ও উন্নয়ন আইন, ২০২৪” (Unified Waqf Management, Empowerment, Efficiency, and Development Act, 2024)।
লোকসভায় ২ এপ্রিল দিবাগত রাতে এই বিলের উপর ভোটাভুটি অনুষ্ঠিত হয়। বিলের পক্ষে বিজেপি নেতৃত্বাধীন এনডিএ (NDA) জোটের নীতিশ কুমারের সংযুক্ত জনতা দল (বিহার), তেলেগু দেশম পার্টি, চিরাগ পাসোয়ানের লোক জনশক্তি পার্টি (নাগাল্যান্ড) প্রভৃতি দলগুলোর সাংসদরা ভোট দেয়, বিলের পক্ষে ভোট পরে ২৮৮টি। বিপক্ষে ভোট দেয় জাতীয় কংগ্রেস, তৃণমূল কংগ্রেস (পশ্চিমবঙ্গ), শারদ পাওয়ারের এনসিপি (মহারাষ্ট্র), অখিলেশ যাদবের সমাজবাদী পার্টি (উত্তর প্রদেশ), ডিএমকে (তামিলনাড়ু), শিবসেনার (মহারাষ্ট্র) প্রভৃতি দলের সাংসদরা, বিপক্ষে ভোট পরে ২৩২টি। টানা ১৩ ঘন্টার অধিবেশনে ৫৬ ভোটের ব্যবধানে পাশ হয় ওয়াক্ফ সংশোধনী বিল।
সংশোধনকৃত আইনে যা যা থাকছে-
১৯৫৫ সালে প্রথম ওয়াক্ফ আইনের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত ওয়াক্ফ বোর্ড একটি স্বাধীন সংস্থা। যেকোনো নিজস্ব সিদ্ধান্ত বোর্ড সভায় গৃহীত হতে পারে। বর্তমানে পাশকৃত বিলে বোর্ডের ক্ষমতা হ্রাস করা হচ্ছে। অমুসলিম প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (CEO) নিয়োগ, অমুসলিম ২জন বোর্ড সদস্য নিয়োগ, ৩ জন মুসলিম মহিলা সদস্য নিয়োগ ইত্যাদি ব্যবস্থা রাখা হচ্ছে। বোর্ড চাইলে যে কোনো মুসলমানের জমি বা সম্পত্তি গ্রহণ করতে পারতো এখন থেকে জেলা শাসকের অনুমোদন লাগবে। জেলা পর্যায়ে ওয়াক্ফ কমিটি গঠন করা হবে। ওয়াক্ফ ট্রাইবুন্যালের সিদ্ধান্তের পরে ৯০ দিনের মধ্যে হাইকোর্টে আপীল দায়ের করা যাবে। রাজ্য সরকার ৬ মাসের মধ্যে বোর্ডের সিইও নিয়োগ না করলে কেন্দ্রীয় সরকার নিয়োগ দিতে পারবে। কেন্দ্রীয় সরকারের অনুমোদন ছাড়া বোর্ড কোনো ওয়াক্ফকৃত সম্পত্তি হস্তান্তর করতে পারবে না। প্রতিটি জেলায় ওয়াক্ফ সম্পত্তির নিবন্ধন করতে হবে। ওয়াক্ফ এস্টেটের আয় বছরে ১ লক্ষ টাকার বেশি সরকারি অডিট করতে হবে।
২০০৫ সালে তৎকালীন কংগ্রেস সরকারের আমলে বিচারপতি রাজিন্দর সাচারের নেতৃত্বে ভারতীয় মুসলিমদের জীবনযাত্রা শিক্ষা স্বাস্থ্য সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন করার লক্ষ্যে সমীক্ষার জন্য সাচার কমিশন গঠন করে। কমিশন ২০০৬ সালে সরকারের কাছে মুসলিম জনগোষ্ঠীর উন্নয়নে বেশ কিছু প্রস্তাব পেশ করে, তারমধ্যে ওয়াক্ফ সম্পত্তির সদ্ব্যবহার করলে তার থেকে বছরের ১২০০ হাজার কোটি টাকা আয় করা সম্ভব বলে সুপারিশ করেন। এই আয় থেকে দরিদ্র মুসলমানের জীবনমানের উন্নয়ন করা সম্ভব। এই প্রেক্ষিতেই ২০১৩ সালে কংগ্রেস সরকার উক্ত আইন সংশোধন করেছিল।
এবার সাচার কমিশনের রিপোর্ট দেখিয়ে নরেন্দ্র মোদী সরকার ওয়াক্ফ বোর্ড আইন ১৯৯৫ এর সংশোধন করছে। বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো এ সংশোধনীর বিরোধীতা করছে।
এ প্রসঙ্গে জাতীয় কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী তাঁর এক্স (টুইটার) হ্যান্ডলে লিখেন, “ওয়াকফ সংশোধনী বিলটি মুসলমানদের প্রান্তিকীকরণ এবং তাদের ব্যক্তিগত আইন ও সম্পত্তির অধিকার হরণ করার একটি অস্ত্র। আরএসএস, বিজেপি এবং তাদের মিত্রদের দ্বারা সংবিধানের উপর এই আক্রমণ আজ মুসলমানদের লক্ষ্য করে করা হলেও কিন্তু ভবিষ্যতে অন্যান্য সম্প্রদায়কে লক্ষ্য করার জন্য একটি নজির স্থাপন করবে। কংগ্রেস দল এই আইনটির তীব্র বিরোধিতা করছে কারণ এটি বহুত্ববাদী ভারতের ধারণাকে ক্ষতিগ্রস্ত করে এবং সংবিধানের অনুচ্ছেদ ২৫ এর ধর্মের স্বাধীনতার অধিকারকে লঙ্ঘন করে।”
সোনিয়া গান্ধী বলেন, “ওয়াক্ফ বিল যেন বুলডোজিং এবং সংবধিানের উপর নির্লজ্জ আক্রমণ।”
সাংসদ ব্যারিস্টার আসাদউদ্দীন ওয়াইসি বলেন, “সরকার ওয়াক্ফ আইনের যে সংশোধনী করছে তা সংবিধানের ২৬ নম্বর অনুচ্ছেদের লঙ্ঘন। বিজেপি দেশে সংঘাত তৈরি করতে চাইছে। আগামীকাল কালেক্টর এবং ডিএম বলবেন যে এটি সরকারি সম্পত্তি এবং সেখানে পোস্টার সাঁটাবেন। মসজিদগুলো বন্ধ করে দেওয়া হবে। এই আইন পাস হলে, দেশের প্রাচীন মন্দিরগুলি সুরক্ষিত হবে, কিন্তু মসজিদগুলি নয়। এই আইনে দেশের বৃহত্তম সংখ্যালঘুদের উপর আক্রমণ করা হচ্ছে। এতে মুসলিমদের দারিদ্র্য দূর করবে না। এই বিল সব ধর্মের সমতার যে সাংবিধানিক বিধান রয়েছে, তার পরিপন্থী। এটি সংবিধানের ২৫ অনুচ্ছেদেরও লঙ্ঘন করে। এই বিলের উদ্দেশ্য মুসলমানদের অপমান করা এবং দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক তৈরি করা।”
বিলের পক্ষে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বলেন, “বিগত কয়েক দশক ধরে ওয়াক্ফ ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহিতার অভাব ছিল। বিশেষ করে মুসলিম মহিলা, দরিদ্র মুসলিম, পশমন্দা মুসলিমদের স্বার্থের ক্ষতি করেছে। সংসদে পাস হওয়া আইনে ওয়াক্ফের স্বচ্ছতা বৃদ্ধি করবে এবং জনগণের অধিকারও সুরক্ষিত করবে।”
উল্লেখ্য, বর্তমানে ওয়াক্ফ বোর্ডের অধীনে কৃষি জমির পরিমাণ ১ লক্ষ ৪০ হাজার ১০৮ একর, কবরস্থানের সংখ্যা ১ লক্ষ ৪৯ হাজার ৯৫১টি,, মসজিদ ১ লক্ষ ১৭ হাজার ৪১৩টি, দোকান ১ লক্ষ ৬২ হাজার ৮০১টি, বাড়ি ৯০ হাজার, দরগা ও মাজার ৩৩ হাজার, ঈদগাহ ৯ হাজার, মাদ্রাসা ১৩ হাজার ৭১৯টি, স্কুল ২ হাজার ৪২টি। বোর্ডের আয় ২০২০-২০২১ সালে ১০৪ কোটি টাকা, ২০২১-২০২২ সালে ৬১ কোটি টাকা, ২০২২-২০২৩ সালে ২৭ কোটি টাকা এবং ২০২৩-২০২৪ সালের আয় ১৪ কোটি টাকা।
গ্রন্থণায়- ওয়াজেদ নবী, এডিটর, জরিস্টিকো ব্লগ।