HomeOpinion

দণ্ড মওকুফে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা সংস্কার সময়ের দাবী

বাংলাদেশ রাষ্ট্রের নিয়মতান্ত্রিক সর্বোচ্চ পদধারী হিসেবে রাষ্ট্রপতি আইন, বিচার ও শাসন বিভাগের অভিভাবকত্ব করেন। এই অভিভাকত্বের এখতিয়ারের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রপতি বেশ কিছু সাংবিধানিক ও আইনগত একচ্ছত্র ক্ষমতা ভোগ ও প্রয়োগ করে থাকেন। এমন একটি সাংবিধানিক ও আইনগত একচ্ছত্র ক্ষমতা হলো দণ্ড মওকুফের ক্ষমতা। বাংলাদেশ সংবিধানের ৪৯ নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, “কোনও আদালত, ট্রাইব্যুনাল বা অন্য কোনও কর্তৃপক্ষ কর্তৃক প্রদত্ত যে কোনও দণ্ডের মার্জনা, বিলম্বন ও বিরাম মঞ্জুর করিবার এবং যে কোনও দণ্ড মওকুফ, স্থগিত বা হ্রাস করিবার ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির থাকিবে।” এছাড়াও বাংলাদেশ দণ্ডবিধি ১৮৬০ এর ৫৪ ধারা এবং ৫৫ক উপ-ধারায় রাষ্ট্রপতি তথা রাষ্ট্রকে ‘মৃত্যু*দণ্ড’ মওকুফের নিরংকুশ ক্ষমতা প্রদান করা হয়েছে।

বিচারিক আদালত এবং পরে উচ্চ আদালতের সব রকম বিচারিক প্রক্রিয়া সম্পন্ন হবার পর ‘মৃত্যু*দণ্ড’, যাবজ্জীবন বা অন্যান্য দণ্ডপ্রাপ্ত অপরাধীরা কারা কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে প্রথমে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে দণ্ড মওকুফের আবেদন করেন, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে যাচাই বাছাইয়ের পর তা প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে প্রেরণ করা হয়। উক্ত আবেদনে প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদন পাওয়া গেলে আবেদনটি রাষ্ট্রপতির কার্যালয়ে পাঠানো হয়। প্রধানমন্ত্রীর সিলমোহর দণ্ড মওকুফের ফাইলে পড়ার পর রাষ্ট্রপতির সিলমোহর অবধারিত ভাবেই পড়ে থাকে। এভাবে একজন দণ্ডপ্রাপ্ত অপরাধী ক্ষমা বা আংশিক ক্ষমা পেয়ে যায়। রাষ্ট্রপতি বা সরকার কি কারণে দণ্ড মওকুফ করেছেন তার কারণ ব্যাখ্যা করা হয় না, কখোনো প্রকাশও করা হয় না।

বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভের পর থেকে চলতি ২০২৪ সাল পর্যন্ত প্রায় দুইশত দণ্ডিত অপরাধীর দণ্ড মওকুফ করা হয়েছে। সিংহভাগই শুধুমাত্র রাজনৈতিক বিবেচনায় করা হয়েছে বলে তীব্র সমালোচনা রয়েছে। বিএনপি সরকারের আমলে ‘মৃত্যু*দণ্ডে’ দণ্ডিত বিএনপি নেতা মহিউদ্দিন ঝিণ্টুর দণ্ড মওকুফ, আওয়ামী লীগ সরকার আমলে লক্ষীপুরের আওয়ামী লীগ নেতা আবু তাহেরে ছেলে ‘মৃত্যু*দণ্ডে’ দণ্ডিত আফতাব উদ্দিন বিপ্লবের দণ্ড মওকুফ এছাড়াও সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদের ছোটভাই গ্যাংস্টার খ্যাত জোসেফ আহমেদের ‘মৃত্যু*দণ্ড’ মওকুফসহ আওয়ামীলীগ সরকারের টানা চার মেয়াদের ক্ষমতায় উল্লেখযোগ্য সংখ্যক দণ্ড মওকুফের ঘটনা ঘটেছে।

‘হত্যা’ বা অন্য যেকোনো একক অপরাধমূলক কার্যক্রমকে সমগ্র রাষ্ট্র এবং সমাজের বিরুদ্ধে সংঘটিত অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ফৌজদারী আদালতে অপরাধমূলক কাজের বিচারও হয় রাষ্ট্র বনাম সন্ধিগ্ধ অভিযুক্ত অপরাধীর। বিচার শেষে অপরাধ প্রমাণিত হলে অপরাধীকে কৃত অপরাধের দায়ে মাত্রানুযায়ী শাস্তি প্রদান করা হয়। শাস্তির নীতি হলো অপরাধীকে দণ্ড প্রদানের মাধ্যমে ভোক্তভোগীকে প্রতিকার প্রদান করা, সমাজে শান্তিশৃঙ্খলা বজায় রাখা, অপরাধীর পরিণতির দৃষ্টান্ত স্থাপন করা এবং অপরাধীকে সংশোধনের সুযোগ প্রদান করা। ধরা যাক কোনো একটি মধ্য বা নিম্মবিত্ত পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি অন্যায়ভাবে হ*ত্যা*কাণ্ডের শিকার হয়ে প্রাণ হারালেন। এই ব্যক্তি হত্যার শিকার হবার কারণে তার পরিবার উপার্জন অক্ষমতার কারণে আর্থিক দুর্দশায় পড়বে, অভিভাবকহীন হয়ে পড়বে। এমন অবস্থায়ও সেই ব্যক্তির পরিবার হত্যার ঘটনায় প্রতিকার পাবার আশায় বিচারপ্রক্রিয়ার দ্বারস্থ হবে। দেশের বিচারব্যবস্থায় সময় এবং আর্থিক বিষয়আশয় সম্পর্কে সবারই ধারণ রয়েছে। সাত থেকে আট বছর আদালতের পেছনে সময়, শ্রম ও অর্থ দিয়ে পরিবারটি যদি অভিযুক্তকে দণ্ডিত হিসেবে দেখতে পায় তখন ভোক্তভুগী পরিবারটি একটু স্বস্তি বোধ করে। এমন অবস্থায় রাষ্ট্রপতি বা সরকার যদি ভোক্তভুগীদের দিকে না তাকিয়ে এ ধরনের অপরাধীর দণ্ড মওকুফ করে দেয়- তাহলে এমন অসহায় ভোক্তভুগীদের সাথে রাষ্ট্র বিচারের নামে প্রহসন করলো কিনা সেই প্রশ্ন ওঠে! রাষ্ট্রের ন্যায়বিচারের সদিচ্ছা নিয়েও প্রশ্ন উঠে!

নতুন প্রত্যাশা ও প্রত্যয় নিয়ে যাত্রা করা বিশ্বনন্দিত ব্যক্তিত্ব নোবেল বিজয়ী প্রফেসর ড. ‍মুহম্মদ ইউনুস ও তাঁর সরকারের কাছে আমাদের আবেদন থাকবে- ন্যায়বিচার ও আইনের শাসনের ভিত্তিতে রাষ্ট্র গঠনের অংশ হিসেবে রাষ্ট্রপতি এবং সরকারের দণ্ড মওকুফের ক্ষমতার সংস্কার যৌক্তিক সংস্কার করা হোক। দণ্ড মওকুফের আবেদনের উপর সরাসরি ভুক্তভোগীকে রাষ্ট্রপতির মুখোমুখি সাক্ষাতের মাধ্যমে মতামত নেয়ার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। ভুক্তভোগীদের জন্য উপযুক্ত পরিমাণ ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে। ‘মৃত্যু*দণ্ড’ এবং যাবজ্জীবন সাজা প্রাপ্ত হত্যামামলার আসামীকে পুরোপুরি মওকুফ না করে নির্দিষ্ট মেয়াদ বা আমৃত্যু কারাদণ্ড দেয়া যেতে পারে।

সাংবিধানিক এবং আইনগতভাবে রাষ্ট্রপতি এবং  সরকারের দণ্ড মওকুফের একচ্ছত্র ক্ষমতাকে ন্যায়বিচারের পরিপন্থী মনে করে আমরা তা সংস্কারের জোর দাবী জানাচ্ছি।

*লেখক- ওয়াজেদ নবী, এডিটর, জুরিস্টিকো ব্লগ

 

আরও পড়ুন- অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে সংস্কার প্রস্তাব

You cannot copy content of this page