রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন ও বাস্তবতা
মিয়ানমারের জান্তা সরকার বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে ১ লাখ ৮০ হাজার রোহিঙ্গা শরণার্থী ফিরিয়ে নেওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন। গত ১৪ মার্চ প্রধান উপদেষ্টা ড.ইউনুস এবং জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্টিনিও গুতেরেস কক্সবাজারের রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবির পরিদর্শন করেন। এ সময় ২ নেতা রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন বিষয়ে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেয়ার কথা বলেন। পরিদর্শনকালে ড. ইউনূস বলেন, “আগামী ঈদ (২৬ সালের) আপনারা (রোহিঙ্গারা) আপনাদের ভূমিতে করতে পারবেন।” এছাড়াও বাংলাদেশ সরকার খুব শীঘ্রই বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক বিষয়ক কনফারেন্স আয়োজন করবে বলে শুনা যাচ্ছে। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কাজ করার জন্য কূটনীতি ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞ ড. খলিলুর রহমানকে প্রধান উপদেষ্টার উচ্চপ্রতিনিধি (High Reprentative) নিয়োগ করা হয়েছে। তিনি পশ্চিমা বিশ্বে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে কাজ শুরু করেছেন ইতোমধ্যে। এ পটভূমিতে রোহিঙ্গা নিয়ে মিয়ানমারের জান্তা সরকার বেশ চাপ অনুভব করছে বলে ধারণা করা যায়।
চাপের প্রতিক্রিয়া হিসেবে জান্তা নিজেরাই রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের জন্য আগ্রহ প্রকাশ করেছে। গতকাল ৪ এপ্রিল (শুক্রবার) থাইল্যান্ডের রাজধানী ব্যাংককে বিমসটেক (BIMSTEC) এর ৬ষ্ঠ সম্মেলনের সাইডলাইন বৈঠকে মিয়ানমার জান্তা প্রধান ও প্রধানমন্ত্রী সিনিয়র জেনারেল মিন অং হ্লাইং প্রধান উপদেষ্টার সাথে বৈঠকে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের প্রস্তাব দিয়েছেন। নিঃসন্দেহে এটি একটি ভালো খবর। এই প্রেক্ষিতে যে প্রশ্ন দাঁড়াচ্ছে, তা হলো যে রাখাইন প্রদেশে মিয়ানমার জান্তা সরকার রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন সেখানে বর্তমানে জান্তা সরকারের নিয়ন্ত্রণ নেই। রাখাইন প্রদেশ এখন সম্পূর্ণ সশস্ত্র বিদ্রোহী সংগঠন আরাকান আর্মির দখলে। আরাকান আর্মি রাখাইন প্রদেশকে আরাকান নামে (আরাকান রাখাইনের পূর্বনাম) আলাদা রাষ্ট্র গঠনের তৎপড়তা চালাচ্ছে। ২০২১ সালে নোবেলজয়ী নেত্রী অংসাং সুচির নেতৃত্বাধীন বেসমারিক সরকারকে উৎখাত করে সামরিক শাসন জারি করেছে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। এরপর থেকেই ব্যাপক প্রতিবাদ বিক্ষোভ শেষ পর্যন্ত সশস্ত্র বিদ্রোহের রূপ নেয়।
মিয়ানমারের জান্তা বিরোধী থ্রি বাদারহুড অ্যালায়েন্সের একটি হলো আরাকান আর্মি। ২০২৩ সালের অক্টোবরে এ জোট রাখাইনে ব্যাপক হামলা শুরু করে। তাদের সঙ্গে জান্তা বাহিনীর সংঘাতে রোহিঙ্গাদের জন্য রাখাইনে ফেরার পরিস্থিতি আরো সংকটাপন্ন হয়ে ওঠে।
এখন গভীর ভাবনার বিষয় হচ্ছে আদৌও কি ড. ইউনুস রোহিঙ্গাদেরকে মিয়ানমারের ফেরত পাঠাতে পারবেন ২০১৮ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে ৮ লাখ রোহিঙ্গার একটি তালিকা মিয়ানমারকে দিয়েছিল বাংলাদেশ সরকার, এর মধ্যে এখন পর্যন্ত ১ লাখ ৮০ হাজার রোহিঙ্গা শরনার্থীকে মিয়ানমারের নাগরিক হিসেবে চূড়ান্তভাবে নিশ্চিত করেছে দেশটির জান্তা সরকার। তাদের ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য উপযুক্ত হিসেবে বিবেচনা করছে। জাতিসংঘ শরণার্থী বিষয়ক হাইকমিশনের হিসেব মতে বাংলাদেশের ক্যাম্পগুলোয় সব মিলিয়ে এখন রোহিঙ্গার সংখ্যা ১২ লাখেরও বেশি। এর মধ্যে প্রায় ৮ লাখ রোহিঙ্গা ঢুকেছে ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর থেকে পরবর্তী কয়েকমাসে। ১ লাখ ৮০ হাজার রোহিঙ্গা শরণার্থী মিয়ানমার ফেরত নিতে সচেষ্ট হয় তাহলে বাকি ১০ লাখ ২০ হাজার রোহিঙ্গার ভবিষ্যৎ কি হবে সেটাও এখন ভাবনার বিষয়।
২০১৭ সালের নভেম্বর মাসে অং সান সুচির বেসামরিক সরকারের সাথে চীনের সহায়তায় বাংলাদেশ সরকার রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন চুক্তি করে। চুক্তির শর্তানুযায়ী ২০১৮ সালে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের কথা থাকলেও তা আর আলোর মুখ দেখেনি।
এছাড়াও ২০১৯ সালে প্রত্যাবাসনের আরও একবার উদ্যোগ নিলেও নাগরিকত্বের বিষয়ে সুরাহা না হওয়ায় রোহিঙ্গারা স্বেচ্ছায় যেতে চায়নি।
*লেখক: মো. হাবিবুর রহমান, সাব-এডিটর, জুরিস্টিকো ব্লগ।