সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ এবং বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতা
৫ আগস্ট শেখ হাসিনা রেজিমের পতন পরবর্তী সময়ে রাজনীতির মাঠে সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৭০ আলোচনার তুঙ্গে। সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে- “কোন নির্বাচনে কোন রাজনৈতিক দলের প্রার্থীরুপে মনোনীত হইয়া কোন ব্যক্তি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হইলে তিনি যদি –
(ক) উক্ত দল হইতে পদত্যাগ করেন, অথবা
(খ) সংসদে উক্ত দলের বিপক্ষে ভোটদান করেন,
তাহা হইলে তাঁহার আসন শূন্য হইবে, তবে তিনি সেই কারণে পরবর্তী কোনো নির্বাচনে সংসদ সদস্য হইবার অযোগ্য হইবেন না।”
বিভিন্ন সময়ে বুদ্ধিজীবী, নাগরিক অধিকার কর্মী এবং সংসদ সদস্যরা ৭০ অনুচ্ছেদ সংস্কার করার দাবি জানিয়ে আসছেন। ১৭ এপ্রিল, ২০১৭ সালে অনুচ্ছেদটি চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্ট বিভাগে রিট আবেদন করা হয়। হাইকোর্ট বিভাগ তা আমলে না নিয়ে খারিজ করে দেয়।
ড. আলী রিয়াজের নেতৃত্বাধীন সংবিধান সংস্কার কমিশনে মোট ৩৪ টি রাজনৈতিক দল সংবিধান সংস্কার বিষয়ে লিখিত প্রস্তাব জমা দিয়েছে। এরমধ্যে বেশিরভাগ দলই সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ বাতিল বা সংস্কার চেয়েছে।
এখন প্রশ্ন হলো ৭০ অনুচ্ছেদ বাতিল নাকি সংস্কার?
উক্ত প্রশ্নের যৌক্তিক উত্তর খুঁজতে হলে আমাদের দু’টি বিধানকেই বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনা করতে হবে।
প্রথমত, “পদত্যাগের ফলে সংসদ সদস্য পদ বাতিল ” এই বিধানটি সংবিধানে না থাকলে সহজেই সরকার পতন বা অস্থিরতা সৃষ্টি হতে পারে। বিশেষত যদি সংখ্যাগরিষ্ঠতা হ্রাস পায়। যেমন- শ্রীলঙ্কায় ২০২১ সালে কিছু সংসদ সদস্য ক্ষমতাসীন দল ত্যাগ করে। এর ফলে সরকারকে কার্যক্রম পরিচালনার জন্য পার্লামেন্টে একচেটিয়া সমর্থন হারাতে হয়েছিল, যা দেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতায় প্রভাব ফেলেছিল এবং তীব্র অর্থনৈতিক সংকট দেখা দিয়েছিল।
সংসদ সদস্যের দলত্যাগ জনগণের মধ্যে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে, যা উক্ত রাজনৈতিক দলের জন্য বিভ্রান্তিকর। এমনকি এই প্রভাব ভোটের মাঠেও লক্ষণীয় হতে পারে। তাই সহজেই বলা যায়, এই বিধানটি সংবিধান থেকে বাদ দেওয়া উচিৎ হবে না।
দ্বিতীয়ত, “সংসদে নিজ দলের বিপক্ষে ভোটদান করলে সংসদ সদস্য পদ বাতিল” এই বিধানটি সংসদ সদস্যদের স্বাধীনভাবে চিন্তা করার এবং তাঁদের নির্বাচনী এলাকায় জনগণের স্বার্থে কাজ করার অধিকার কেড়ে নেয়।
একজন সংসদ সদস্য তাঁর নির্বাচনী এলাকার জনগণের প্রতিনিধি হিসেবে নির্বাচিত হন, কিন্তু ৭০ অনুচ্ছেদের কারণে তিনি দলের নির্দেশের বাইরে গিয়ে জনগনের দাবি তুলে ধরতে পারেন না। এটি জনগণের কণ্ঠকে দমিয়ে রাখে।
আবার বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে যেকোন সিদ্ধান্ত গ্রহণে সরকার দলীয় প্রধানই সর্বেসর্বা। সংসদ সদস্যরা নিজেদের মতামত প্রকাশ করতে ভয় পায়, ফলে দলীয় প্রধান তার ইচ্ছামতো আইন পাস করতে পারে, যা স্বৈরতন্ত্রের পথ প্রশস্ত করে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, নির্বাচনী আইন সংশোধনীর মতো কিছু বিতর্কিত আইন এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ। গণতন্ত্র ও জনপ্রতিনিধিত্বের প্রশ্নে সংবিধানের এই বিধানটি একপ্রকার বিষফোঁড়া।
পরিশেষে বলা যায়, ৭০ অনুচ্ছেদ না থাকলে সংসদ সদস্যদের কেনাবেচা বা প্রলোভনের মাধ্যমে দলত্যাগের ঘটনা ঘটতে পারে, যা বাংলাদেশের রাজনীতিতে ইতিমধ্যে একটি সমস্যা। ৭০ অনুচ্ছেদ সম্পূর্ণ বাতিল বা সংস্কারের চেয়ে আংশিক বাতিল করা বেশি যৌক্তিক হতে পারে, যাতে গণতান্ত্রিক এবং রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার মধ্যে ভারসাম্য বজায় থাকে। এ বিষয়ে সংস্কার কমিশন, রাজনৈতিক দল এবং অন্যান্য অংশীজনদের সর্বসম্মতিক্রমে সর্বোৎকৃষ্ট সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া সম্ভব বলে বিশ্বাস রাখি।
*লেখক: নাবিদ মোস্তফা জাসিম- শিক্ষার্থী, আইন বিভাগ, নর্দান বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ, ঢাকা।