BlogFeature

বাংলাদেশ সংবিধানের আদ্যোপান্ত

গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আইন। এটি একটি লিখিত দলিল।

বাংলাদেশের সংবিধানটির রচনা কমিটি গঠন করা হয়েছিল ১১ এপ্রিল, ১৯৭২ সালে।  সংবিধান রচনা কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন  ড. কামাল হোসেন ও কমিটির সদস্যসংখ্যা ছিল ৩৪। খসড়া সংবিধান গণপরিষদে উত্থাপন করা হয়েছিল ১৯৭২ সালের ১২ অক্টোবর।

১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দের ৪ঠা নভেম্বর তারিখে বাংলাদেশের জাতীয় সংসদে সংবিধান গৃহীত হয় এবং একই বছরের ১৬ই ডিসেম্বর অর্থাৎ বাংলাদেশের বিজয় দিবসের প্রথম বার্ষিকীতে কার্যকর হয়। বাংলাদেশে ৪ নভেম্বর  ‘সংবিধান দিবস’ হিসেবে পালন করা শুরু হয়।

আমাদের এই সংবিধানটি গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা এবং জাতীয়তাবাদের প্রতি প্রতিশ্রুতি প্রকাশ করে, যা জাতির প্রতিষ্ঠাকালীন আদর্শকে প্রতিফলিত করে।

বাংলাদেশের সংবিধানটি প্রস্তাবনা দিয়ে শুরু হয়। এই সংবিধান এ মোট ১৫৩টি অনুচ্ছেদ রয়েছে। সংবিধানটিতে ৭টি তফসিল দিয়ে শেষ হয়েছে ।

বাংলাদেশের সংবিধান মোট ১১টি ভাগে বিভক্ত এবং প্রতিটি ভাগে বিভিন্ন অধ্যায় রয়েছে যা রাষ্ট্র পরিচালনা এবং নাগরিকদের মৌলিক অধিকার ও কর্তব্য নির্ধারণ করে।

 

সংবিধানের ১১টি ভাগ এবং বিষয়বস্তুগুলো হল:

১.প্রস্তাবনা: সংবিধানের শুরুতেই  প্রস্তাবনা লিপিবদ্ধ করা হয়েছে, এই প্রস্তাবনার মাধ্যমে  বাংলাদেশের জনগণের সার্বভৌমত্ব এবং গণতান্ত্রিক শাসনের প্রতি তাদের প্রতিশ্রুতি ঘোষণা করে।

২. প্রজাতন্ত্র:  প্রজাতন্ত্রের গঠন, সার্বভৌমত্ব, এবং জাতীয় প্রতীক সম্পর্কিত বিধান এটি ।

৩. রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি: রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য মৌলিক নীতি এবং লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে । এর মধ্যে অর্থনৈতিক ও সামাজিক ন্যায়বিচার, সমতা, এবং অন্যান্য মূলনীতি অন্তর্ভুক্ত।

৪. মৌলিক অধিকার: বাংলাদেশের নাগরিকদের মৌলিক অধিকার এবং স্বাধীনতা সংক্রান্ত বিধান। এর মধ্যে বাকস্বাধীনতা, ধর্মীয় স্বাধীনতা, সমানাধিকারের অধিকার ইত্যাদি অন্তর্ভুক্ত।

৫. কার্যনির্বাহী বিভাগ: রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, এবং মন্ত্রিসভা সম্পর্কিত বিধান। কার্যনির্বাহী বিভাগের দায়িত্ব এবং ক্ষমতা নির্ধারণ করা হয়েছে।

৫. আইনসভা: জাতীয় সংসদের গঠন, ক্ষমতা, কার্যাবলী এবং আইন প্রণয়নের পদ্ধতি সম্পর্কিত বিধান।

৭. বিচার বিভাগ: বিচার বিভাগের স্বাধীনতা এবং কার্যাবলী সম্পর্কিত বিধান। সুপ্রিম কোর্ট, হাইকোর্ট, এবং অন্যান্য নিম্ন আদালতের গঠন ও কার্যাবলী।

৮. নির্বাচন: নির্বাচন কমিশন এবং নির্বাচনী প্রক্রিয়া সম্পর্কিত বিধান।

৯. মহা হিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক: মহা হিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক এর কার্যাবলী এবং দায়িত্ব সম্পর্কিত বিধান।

১০. পাবলিক সার্ভিস কমিশন: সিভিল সার্ভিস এবং অন্যান্য সরকারি কর্মচারী সম্পর্কিত বিধান।

১১. সংশোধনী ও অন্যান্য: সংবিধানের সংশোধনী এবং অন্যান্য বিবিধ বিষয় সম্পর্কিত বিধান।

 

সংবিধানের এই ভাগগুলোর মাধ্যমে দেশের শাসন ব্যবস্থার কাঠামো ও কার্যাবলী নির্ধারিত হয়ে থাকে । এটি দেশের আইন এবং বিচার ব্যবস্থার মূল ভিত্তি এবং জাতির সার্বভৌমত্বের প্রতীক হিসেবে কাজ করে।

 

বাংলাদেশের সংবিধান দেশের শাসনব্যবস্থার মূল ভিত্তি হিসেবে কাজ করে। এটি রাষ্ট্রের বিভিন্ন শাখার কাঠামো এবং তাদের ক্ষমতা ও কার্যাবলী নির্ধারণ করে। সংবিধানের মাধ্যমে একটি সুসংগঠিত ও কার্যকর শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

সংবিধানের শাসনব্যবস্থার ভিত্তি নিম্নরূপ কিছু :

১. রাষ্ট্রের কাঠামো সংবিধানে বাংলাদেশের রাষ্ট্র কাঠামোকে প্রজাতন্ত্র হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। রাষ্ট্রের সার্বভৌম ক্ষমতা জনগণের মধ্যে নিহিত এবং রাষ্ট্র পরিচালনা হবে গণতান্ত্রিক নীতিতে।

২. কার্যনির্বাহী বিভাগ: কার্যনির্বাহী বিভাগ বা এক্সিকিউটিভ বিভাগের মূল প্রধান হলেন রাষ্ট্রপতি। তবে, প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে মন্ত্রিসভা কার্যনির্বাহী ক্ষমতা প্রয়োগ করে। রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী কাজ করেন।

রাষ্ট্রপতি: রাষ্ট্রের প্রধান এবং সামরিক বাহিনীর সর্বাধিনায়ক। রাষ্ট্রপতি জাতীয় সংসদের সদস্যদের ভোটে নির্বাচিত হন। আন্তর্জাতিক চুক্তি এবং চুক্তিপত্রে স্বাক্ষর করেন।

প্রধানমন্ত্রী: প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা এবং সরকারের প্রধান। মন্ত্রিসভা গঠন ও নেতৃত্ব প্রদান করেন। সরকারের নীতিমালা এবং প্রশাসনিক কাজ পরিচালনা করেন।

৩. আইনসভা: জাতীয় সংসদ হলো দেশের আইন প্রণয়নকারী প্রধান প্রতিষ্ঠান। এটি এককক্ষবিশিষ্ট আইনসভা, যেখানে সরাসরি জনগণের ভোটে নির্বাচিত সংসদ সদস্যরা বসেন। জাতীয় সংসদ সদস্যরা জনগণের প্রতিনিধিত্ব করেন এবং নতুন আইন প্রণয়ন, বিদ্যমান আইন সংশোধন, এবং সরকারের কার্যকলাপ পর্যবেক্ষণ করেন।অধিবেশন: সংসদ বছরে দুটি নিয়মিত অধিবেশন করে, যেখানে বিভিন্ন আইন এবং নীতিমালা আলোচনা ও অনুমোদন করা হয়।

৪. বিচার বিভাগবিচার বিভাগ সংবিধানের অধীনে স্বাধীন এবং তা ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার জন্য কাজ করে।

সুপ্রিম কোর্ট:

হাইকোর্ট বিভাগ: প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে কাজ করে এবং নিম্ন আদালতের কার্যক্রম তদারকি করে।

আপিল বিভাগ: উচ্চ আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল শুনানি করে।

৫. স্থানীয় সরকার: স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার মাধ্যমে জনগণের নিকটবর্তী শাসন প্রক্রিয়া প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এর মধ্যে ইউনিয়ন পরিষদ, পৌরসভা, এবং সিটি কর্পোরেশন অন্তর্ভুক্ত।

৬. স্বাধীন প্রতিষ্ঠান: সংবিধান কিছু স্বাধীন প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেছে, যা সরকারের কার্যাবলী পর্যবেক্ষণ এবং নির্দিষ্ট ক্ষেত্রগুলোতে বিশেষজ্ঞ মতামত প্রদান করে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য:

নির্বাচন কমিশন: স্বাধীনভাবে নির্বাচন পরিচালনা করে।

মহা হিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক: সরকারি অর্থের হিসাব পর্যালোচনা ও নিরীক্ষণ করে।

সংবিধানে মৌলিক অধিকার এবং স্বাধীনতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণভাবে প্রতিস্থাপন করা আছে । এটি নাগরিকদের জীবনযাত্রার মান উন্নত করতে এবং তাদের স্বাধীনতা ও মর্যাদা রক্ষা করতে সহায়ক। সংবিধানের তৃতীয় ভাগে মৌলিক অধিকার এবং স্বাধীনতার বিধানগুলি উল্লেখ করা হয়েছে।

বাংলাদেশের সংবিধানে আইন ও বিচার ব্যবস্থা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে। এটি একটি স্বাধীন ও নিরপেক্ষ বিচার ব্যবস্থা নিশ্চিত করার মাধ্যমে ন্যায়বিচার প্রদান এবং আইন শৃঙ্খলা রক্ষা করতে সহায়ক। সংবিধানের ষষ্ঠ ভাগে আইন ও বিচার ব্যবস্থা সংক্রান্ত বিভিন্ন বিধান উল্লেখ করা হয়েছে।

 

সংবিধান সংশোধন পদ্ধতি

প্রাসঙ্গিক অনুচ্ছেদ: অনুচ্ছেদ ১৪২ এ সংবিধান সংশোধন পদ্ধতি সম্পর্কে নির্দিষ্ট বিধান রয়েছে। এই অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, সংবিধান সংশোধনের জন্য নিম্নলিখিত প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে হয়:

১. সংসদে বিল উত্থাপনসংবিধান সংশোধনের জন্য একটি বিল জাতীয় সংসদে উত্থাপন করতে হয়। এটি কোনও সংসদ সদস্য দ্বারা প্রস্তাবিত হতে পারে এবং বিলটি উত্থাপনের জন্য সংসদের সদস্যদের সংখ্যাগরিষ্ঠের সমর্থন প্রয়োজন।

২. দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতাসংবিধান সংশোধনের জন্য সংসদে উপস্থিত ও ভোটদানকারী সদস্যদের দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রয়োজন। অর্থাৎ, সংশোধনী প্রস্তাবটি পাস করতে হলে সংসদের দুই-তৃতীয়াংশ সদস্যের সমর্থন থাকতে হবে।

৩. রাষ্ট্রপতির অনুমোদনসংসদে বিলটি পাস হলে এটি রাষ্ট্রপতির কাছে অনুমোদনের জন্য পাঠানো হয়। রাষ্ট্রপতি অনুমোদন দিলে সংশোধনী কার্যকর হয় এবং সংবিধানের সংশ্লিষ্ট অংশ পরিবর্তিত হয়।

 

বাংলাদেশ সংবিধানের গুরুত্বপূর্ণ সংশোধনসমূহ

প্রথম সংশোধনী (১৯৭৩)

প্রথম সংশোধনীতে সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৩৯ সংশোধন করা হয়, যা বাকস্বাধীনতা এবং সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা সংক্রান্ত।

পঞ্চম সংশোধনী (১৯৭৯)পঞ্চম সংশোধনীতে সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৩৮ এবং ১০০ সংশোধন করা হয়। এটি বিচার বিভাগের কাঠামো এবং কার্যাবলী সংক্রান্ত।

দ্বাদশ সংশোধনী (১৯৯১)দ্বাদশ সংশোধনীতে রাষ্ট্রপতি শাসনব্যবস্থা থেকে সংসদীয় শাসনব্যবস্থায় রূপান্তর করা হয়। এটি প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা বৃদ্ধি এবং রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা হ্রাস করে।

পঞ্চদশ সংশোধনী (২০১১)পঞ্চদশ সংশোধনীতে সংবিধানের মূলনীতি পুনর্বহাল করা হয় এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ব্যবস্থা বাতিল করা হয়। এটি সাংবিধানিকভাবে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত করে।

 

বাংলাদেশের সংবিধান জাতির জন্য একটি দিশারী দলিল। এটি দেশের আইন ব্যবস্থার মূল ভিত্তি এবং রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য একটি গাইডলাইন হিসেবে কাজ করে। সংবিধানটি দেশের নাগরিকদের মৌলিক অধিকার এবং স্বাধীনতা রক্ষা করে এবং জাতির স্থিতিশীলতা ও সমৃদ্ধির পথে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

বাংলাদেশের সংবিধান  এমন একটি দলিল, যা দেশের ইতিহাস, সংগ্রাম এবং মূল্যবোধকে প্রতিফলিত করে। এটি একটি জাতির স্বপ্ন এবং আকাঙ্ক্ষার প্রতিচ্ছবি, যা বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ গঠনে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে চলেছে।

*লেখক- তারিন আহমেদ শৈতী: এডমিন এক্সিকিউটিভ: জুরিস্টিকো।

 

 

আরো পড়ুন- বাংলাদেশে লিগ্যাল এইড সার্ভিস

You cannot copy content of this page